বীরেশ্বর বিবেকানন্দ প্রবন্ধ রচনা
অনুরূপে: (১) মহামানব বিবেকানন্দের মহাজীবন; (২) বিবেকানন্দের জীবন, মানবপ্রেম ও মানবপ্রেমী ও বাণী; (৩) বিবেকানন্দ ও যুবসমাজ।
ভূমিকা:
সৎ যাঁর চিত্ত, মহৎ যাঁর চিন্তা মহান, যাঁর জীবনাদর্শ। তিনিই মহাপুরুষ। সেই নিরিখে বীরেশ্বর বিবেকান্দ আমার প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ। মানবসেবাই ছিল তাঁর মহান ব্রত। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সান্নিধ্য এসে বিবেকানন্দ জীবনের স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ঈশ্বরকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ইট-কাঠ পাথরে নির্মিত দেবালয়ে মনের পবিত্র মন্দিরে।
“বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর,
জীবে প্রেম করে সেই যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
মানব মূর্ত প্রতীক এই বীর সন্ন্যাসী। তাঁর মহত্ত্বে ভরা ব্যক্তিত্ব গোটা ভারতবাসীর কাছে চিরস্মরণীয়।
জন্ম, বংশপরিচয় ও শিক্ষা:
বিবেকানন্দের জন্ম হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি কলকাতার সিমুলিয়ার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত, মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ। আর বাল্য নাম ছিল বিলে। ছেলেবেলায় নরেন্দ্রনাথ ছিলেন খুবই দুরন্ত। নরেন্দ্রনাথ পড়াশোনায় খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন এবং শেষে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিশন বা বর্তমান স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে সাফল্যের সঙ্গে বিএ পাস করেন।
ঈশ্বরচিন্তা ও রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ:
ছাত্রাবস্থাতেই নরেন্দ্রনাথ দর্শনশাস্ত্রে প্রগাঢ় জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর বিষয়টির ওপর অতিরিক্ত আকর্ষণে পাশ্চাত্য দর্শন নিয়েও তিনি গভীরভাবে চর্চা করেন। ‘ঈশ্বর কে’ -এই গভীর তত্ত্বের সন্ধানে তিনি ব্রাষ্মবন্ধু কেশবচন্দ্র সেনের দ্বারস্থ হন। ক্রমে ক্রমে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মালেও তাঁর মনকে ব্যাকুল করে তোলা প্রশ্নের উত্তর তিনি সেখানেও খুঁজে পেলেন না। অবশেষে একদিন রামকৃষদেবের সান্নিধ্য এলেন। উপলব্ধি করলেন জীবনের স্বরূপ। খুঁজে পেলেন জীবনের আশ্রয়। তারপর ঠাকুরের কাছ থেকে সন্ন্যাস ব্রতে দীক্ষা নিয়ে নরেন্দ্রনাথ হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
হিন্দুধর্মের প্রচার:
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাপ্রয়াণ ঘটলো বিবেকানন্দ তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ঠাকুরের পবিত্র বাণী নিখিল বিশ্বে প্রচারকল্পে তিনি হলেন পরিব্রাজক । ঘুরলেন গোটা ভারতবর্ষ। আর্ত, পীড়িত ভারতবাসীর জন্য ব্যথায় তাঁর মন ভরে ওঠে। মনে মনে সংকল্প করলেন দারিদ্র মোচনই হবে। তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।
শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগদান:
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব-ধর্মসম্মেলনের আয়োজন হয় আমেরিকায় শিকাগো শহরে। ভারতের বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে হন স্বামী বিবেকানন্দ। যদিও এই সম্মেলনে তিনি ছিলেন অনাহূত, তবুও মাত্র পাঁচ মিনিটের সুযোগ পেয়ে তিনি সেই সম্মেলনকে চিরস্মরণীয় করে রাখলেন। মঞ্চে উঠেই তিনি আমেরিকাবাসীদের উদ্দেশ্য বলেন-আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃমণ্ডলী।” তুমুল করতালিতে ফেটে পড়ে সম্মেলন। তারপর ব্যাখ্যা করে শোনান বেদান্তবাদ বা হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্যের কথা। সমস্ত ধর্মকে ছাপিয়ে তাঁর মানবধর্ম-বাণী সম্মোহিত করল বিশ্ববাসীকে। এই মহাপুরুষের প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বে আকর্ষিত হয়ে পাশ্চাত্যের অনেক মনীষীর মতো মার্গারেট নোবেল তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নাম হয়- ভগিনী নিবেদিতা।
রামকৃষ্ণ মিশন ও বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠা:
চার বছরব্যাপী বিশ্বভ্রমণ এবং বিশ্বজয় করে স্বদেশে ফিরে আসেন বিবেকানন্দ। ভারতবর্ষের দারিদ্র পীড়িত মানুষের দুঃখ মোচনের জন্য তিনি এক কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। শ্রীরামকৃয়ের ভক্ত ও শিষ্যদের নিয়ে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃত্স্ন মিশন’ তারপর বেলুড়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেলুড়মঠ’।
রচনাবলি ও ভাষণ:
গদ্য রচনাতে বিবেকানন্দ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রকাশভঙ্গি ও বক্তব্যের বলিষ্ঠতায় তাঁর রচনায় একক স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। তাঁর রচিত গ্রন্থ ও বক্তৃতাবলি হল ‘রাজযোগ’ ‘ভক্তিযোগ’, ‘কর্মযোগ’, প্রাচ্য ও ‘পাশ্চাত্য’, ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজক’ ‘ভাববার কথা’ প্রভৃতি। ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে তাঁর বহু রচনা।
যুবসমাজ ও বিবেকানন্দ:
এক শ্রেণিবৈষম্যহীন, বর্ণবিদ্বেষহীন সমাজ গঠনই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের একমাত্র স্বপ্ন। কুসংস্কারমুক্ত হয়ে, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে, জাতপাতের দ্বন্ধ ভুলে গিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। মেথর-মুচি-চণ্ডাল-শূদ্র-ব্রাহ্মণের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এমন এক ভারতবর্ষ গঠনের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যেখান থাকবে না শোষণ, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য আর মৈত্রীর স্বর্গ। এক্ষেত্রে তিনি সবার আগে আহ্বান জানিয়েছিলেন ভারতের যুবসমাজকে। তাদের তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে বলেছেন।
উপসংহার:
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় সমাহিত হন এই বীর সন্ন্যাসী। স্বামীজি বিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু বিশ্ববাসীর জন্য রেখে গেলেন তাঁর মহান জীবনাদর্শ। তাঁর প্রদর্শিত পথ। বাণী আজও সমগ্র বিশ্ব বিনম্র চিত্তে স্মরণ করে।
বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধরচনা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
(যদি কোন ভুল থেকে থাকে তবে তা Typing mistake এর জন্য। আমাদের comment করে জানান আমরা তা সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করবো।)