আমার প্রিয় মহাপুরুষ রচনা
আজকের পোস্টে তোমাদের জন্য থাকছে "আমার প্রিয় মহাপুরুষ রচনা" এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। চলুন এবার পড়া যাক এই রচনাটি।
অনুরূপে: (১) সমাজসেবায় বিদ্যাসাগর; (২) দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর; (৩) সমাজ ও সাহিত্যে বিদ্যাসাগর ।
ভূমিকা:
আমার প্রিয় শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ তথা মহান ব্যক্তিত্ব হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী । মহত্ব ও উদারতার তিনি ছিলেন প্রতিমূর্তি । দরিদ্র অসহায় আশ্রয়হীনদের প্রতি তাঁর মন ছিল করুণায় পরিপূর্ণ । তাই তিনি একই সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ এবং ‘দয়ারসাগর’ । বিদ্যা, সেবা আর ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল এই জ্যোতিষ্ক সম্পর্কে তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “যে দেশে অপরাজেয় নির্ভীক চরিত্র-শক্তি সচরাচর দুর্লভ, সে দেশে নিষ্ঠুর প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্রের নির্বিচার হিতব্রত পালন সমাজের কাছে মহৎ প্রেরণা ।”
জন্ম, বংশপরিচয় এবং শিক্ষা:
১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন । পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়; মাতা ভগবতী দেবী । বিদ্যাসাগর ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী । খুব অল্প বয়সেই তিনি গ্রামের পাঠশালায় ভরতি হন এবং পাঠশালার গুরুমশায়ের স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন । মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতার সঙ্গে কলকাতা গমন করেন । সেখানে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভরতি হন ।
তখন তিনি ন-বছরের বালক । দারিদ্র্যতা তিনি জন্মসূত্রে লাভ করেন । তবু সেই দরিদ্র্যতা কখনোই তাঁর বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি । হেলায় তাকে দূরে ঠেলে বিদ্যাসাগর কৃতিত্বের সঙ্গে প্রতি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করতেন । পুরস্কারস্বরূপ তিনি পেতেন বৃত্তি । ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্র লাভ করলেন ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি । এক কথায় এ সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন । শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষাকেও তিনি তাঁর কঠোর অধ্যাবসায়ের দ্বারা রপ্ত করেছিলেন ।
বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন:
ছাত্রজীবন সমাপ্ত হলে বিদ্যাসাগর প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনাম করেন । পরে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন । তার এক বছর পর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন । আপসহীন ব্যক্তিত্বের জন্য শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর মনান্তর ঘটে ।
ফলে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করেন । এরপরই তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) । ক্রমে ক্রমে এই বিদ্যালয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিগ্বিদিকে । মেট্রোপলিটনের মতো আরও অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনব্যাপী শিক্ষাবিস্তারের আপ্রাণ চেষ্টা করে যান ।
বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতি:
শুধু পুথিগত শিক্ষার মধ্য দিয়ে পণ্ডিত ও জ্ঞানী হওয়া নয়, শিক্ষার আলোকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা এই ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতি । মাতৃভাষার মাতৃদুগ্ধ পান করে শিক্ষিত হয়ে ওঠার কথা বলেন বিদ্যাসাগর । এ ছাড়া পাঠক্রম থেকে ধর্মীয় তত্ত্বের বিলোপ ঘটানোর পক্ষপাতী ছিলেন তিনি । শিক্ষার উপযোগিতাকে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়াই ছিল তার জীবনের ব্রত । সেই উদ্দেশ্যে তিনি ২০ টি বাংলা মডেল স্কুল, ৩২ টি বালিকা বিদ্যালয় এবং অবহেলিত মানুষদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।
সমাজসেবক বিদ্যাসাগর:
বিদ্যাসাগরের সামাজিক দায়বদ্ধতা ছিল অপরিসীম । তাই শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন জরাজীর্ণ সমাজকেও তিনি বিশুদ্ধতা দানে সচেষ্ট হয়েছিলেন । আজীবন বিদ্যাসাগর সহায়সম্বলহীন মানুষের সেবা করে গেছেন অকুণ্ঠচিত্তে । মাতা ভগবতী দেবীর করুণা মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পেরেছিলেন বলেই তিনি করুণার সিন্ধু, ‘দয়ার সাগর’ । বিদ্যাসাগর একই সঙ্গে ছিলেন সমাজসেবক ও সমাজসংস্কারক । এতদিন সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ধর্মের দোহাই দিয়ে যে মেয়েদের গৃহকোণে বন্দি করে রেখেছিল, তিনি তাদের শিক্ষার আলোকে নিয়ে আসেন ।
সমাজ থেকে বাল্যবিবাহের মতো দুষ্ট ব্যাধি দূর করতে তাঁকে অনেক শ্রম স্বীকার করতে হয়েছিল । কৌলীন্যপ্রথা ও বাল্যবিবাহের দৌলতে তৎকালে ঘরে ঘরে ছিল বালবিধবার সংখ্যাধিক্য । বালিকা বয়সে বৈধব্যের যন্ত্রণাকে মেনে নিয়ে গৃহকোণে নীরবে অশ্রুবর্ষণ করার দৃশ্য বিদ্যাসাগরকে বিচলিত করেছে । তিনি বালবিধবাদের পক্ষে কলম ধরে বাল্যবিবাহ রদ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের কথা বললে গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজ গর্জে উঠল । তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে তুলল প্রতিরোধ । তবু কোনো বিরুদ্ধ শক্তিই তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি ।
বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকীর্তি:
বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পী । তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন । তার নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) । 'বাঙ্গালার ইতিহাস' (১৮৪৮); ‘জীবনচরিত’ (১৮৫৪); ‘বর্ণপরিচয়’ (১৮৫৫); ‘কথামালা’ প্রভৃতি গ্রন্থে । এ ছাড়া বাংলা গদ্যে পূর্ণচ্ছেদ (!); কমা (,); সেমিকোলন (;); ড্যাশ (-) চিহ্নের প্রয়োগ করে বাংলাগদ্যকে তিনি আরও সুবিন্যস্ত করে তোলেন ।
উপসংহার:
বিদ্যাসাগর শুধু সমাজসংস্কারক নন; ক্ষুধিত, পীড়িত, অসহায়দের সহায় শুধু নন; তিনি ত্যাগে দীপ্ত, কর্মে মহান, বীর্যে সুগম্ভীর । তাঁর চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ, অক্ষয় মনুষ্যত্ব । ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয় । মহাকর্মযজ্ঞের অবসানে ঈশ্বরচন্দ্র আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন । কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর দুর্বার কর্মপ্রবণতা, মহান আদর্শ ও জীবনপ্রত্যয় । তাই কবি সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়-
“সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয় ।”
বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধরচনা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যদি কোন ভুল থেকে থাকে তবে তা Typing mistake এর জন্য । আমাদের comment করে জানান আমরা তা সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করবো ।