আকবরকে কি প্রকৃত অর্থেই ‘মহান’ আখ্যায় ভূষিত করা যায় - Can Akbar be regarded as The Great
প্রশ্ন- আকবরকে কি প্রকৃত অর্থেই ‘মহান’ আখ্যায় ভূষিত করা যায়? (Can Akbar be regarded as 'The Great' in real sense of the term?)
উত্তর-
মধ্যযুগীয় ভারত-ইতিহাসে একমাত্র মুঘল সম্রাট আকবরকে ‘মহান’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে। সাধারণত যখন একজন সম্রাটের মধ্যে সমস্ত রকম রাজকীয় সদ্গুণাবলীর সমাবেশ ঘটে এবং তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, ইতিহাসে তখনই তাঁকে ‘মহান’ আখ্যায় ভূষিত করা যায়। শের শাহ প্রয়োজনভিত্তিক (utility) শাসনের প্রবর্তন করেছিলেন, কিন্তু আকবরের শাসননীতি ছিল মহত্তম, গভীরতা ও জাতীয়তাবোধে পরিপুষ্ট। আকবরের কার্যাবলী ও নীতির বিশ্লেষণ করলে এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
আভিজাত্য:
সম্রাট আকবরের ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য ছিল রাজোচিত। ফাদার মনসেরেট -এর ভাষায়: “He (Akbar) was in face and stature fit for the dignity of a king.” বংশমর্যাদার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন তৈমুর লঙ ও চেঙ্গিজ খাঁ’র ঐতিহ্যের ধারক। তাঁর বাক্ভঙ্গি ছিল গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং সংযত। আনন্দ বা ক্রোধে কিছুতেই তিনিই আত্মহারা হতেন না। তাঁর মানসিক উৎকর্ষ ছিল গভীর এবং বুদ্ধিমত্তা ছিল প্রখর। মহত্ত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্যায়ের প্রতি কঠোরতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
রাজনৈতিক উদারতা:
আকবর ছিলেন একাধারে সমরকুশলী সেনাপতি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংগঠক। তিনিই প্রথম সমগ্র উত্তর ভারত, মধ্য ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশে একক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। এইভাবে বিচ্ছিন্ন ভারতে জাতীয় রাষ্ট্রগঠনের সূচনা হয়। এক্ষেত্রে আকবর যে দূরদৃষ্টি ও উপলব্ধির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা অভূতপূর্ব। তিনিই প্রথম মুসলমান শাসক যিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্যগঠনে ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য হিন্দুদের আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
ভারতীয় রাজপুতজাতির শৌর্যবীর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাই নিছক গোঁড়ামি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যে-কোনো অমুসলমানকে বর্জনের নীতি তিনি পরিত্যাগ করেন। যে আত্মীয়তার বন্ধনে তিনি রাজপুতদের বাঁধেন, তা কেবল কূটচালই ছিল না, ছিল আন্তরিকতায়ও ভরা। তাঁর এই নীতি যে কত কার্যকরী, তা ভাবীকাল প্রমাণ করেছে। রাজপুত-বিরোধিতার অবসানে যেমন সাম্রাজ্যের উন্নতি সহজতর হয়েছে, তেমনি টোডরমল, মানসিংহ, ভগবান দাস প্রমুখ রাজপুতদের সহায়তায় তাঁর শাসনকাল সমৃদ্ধ হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি উপযোগিতা এবং আন্তরিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন।
সুশাসক:
আকবরের শাসনব্যবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড বলেছেন, “It was severely practical.”। শাসক হিসেবে তাঁর নিজের আদর্শ ছিল ‘জনকল্যাণ’। আকবরই প্রথম একটি সুবিস্তৃত ও সুবিন্যস্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসন কাঠামো স্থাপন করেছিলেন। গ্রাম থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শাসনযন্ত্রের বিন্যাস ছিল যুক্তিপূর্ণ ও কার্যকরী। এতে প্রাদেশিক শাসকদের বিদ্রোহী হবার সম্ভাবনা যেমন কম ছিল, তেমনি দূরবর্তী গ্রামও যাতে শাসন-গুরুত্ব পায় তার ব্যবস্থাও করা ছিল। তাঁর রাজস্বব্যবস্থা ছিল বৈজ্ঞানিক। জমির পরিমাপ, উৎপাদিকা শক্তি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতেই রাজস্ব নির্ধারিত হয়।
রায়তদের শোষিত হবার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। তাঁর বিচারব্যবস্থা ছিল সমানাধিকারের আদর্শে পরিচালিত। আইনের চোখে সবাই ছিল সমান। আকবরের সুদক্ষ পরিচালনায় মুঘল সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। ‘মনসবদার’ - প্রথা প্রবর্তন করে তিনি জায়গির-প্রথার কুফল দূর করতে সফল হয়েছিলেন। বিভিন্ন মনসবদারের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠার ফলে সৈন্যবাহিনীর দক্ষতার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল।
সহিষ্ণুতা:
মহান আকবরের মহত্ত্বের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর সর্বজনীন উদারতার মধ্যে। রাজ্যের নিরাপত্তা ও সুশাসন প্রবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করাও আকবর সম্রাটের কর্তব্য বলে মনে করতেন। তাঁর ‘সুলহ-ই-কুল’ ছিল সর্বজনীন উদারতার নীতি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমানের এই ভারতবর্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হীনমন্যতা থাকলে দেশ শক্তিশালী হবে না। এদেশে সুদৃঢ় ও স্থায়ী সাম্রাজ্যগঠনের প্রাথমিক শর্তই ছিল সামাজিক সমন্বয়। এই কারণে তিনি হিন্দুদের উপর আরোপিত বিভিন্ন বৈষম্যমূলক করের অবসান ঘটান। জিজিয়া কর, তীর্থকর প্রভৃতি রদ করেন। জোরপূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরিতকরণ বা যুদ্ধবন্দি হিন্দুদের ক্রীতদাস রূপে ব্যবহারের নীতিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
সংস্কারক:
আকবরের মন যে কী পরিমাণ গোঁড়ামিমুক্ত ছিল, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েকটি সমাজসংস্কারমূলক কাজের মধ্যে। তিনি এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে হিন্দু-বিধবাদের স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জন (সতীদাহ) বন্ধ করে দেন (১৫৯১ খ্রিঃ)। বহুবিবাহ বন্ধ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলন ঘটানোর জন্যও তিনি দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। হিন্দুধর্মের কুসংস্কারবোধে তাঁর এই আন্তরিকতা নিঃসন্দেহে তাঁর উদার-হৃদয়ের প্রমাণ বহন করে।
শিল্পসাহিত্যে অনুরাগ:
শিল্পসাহিত্যের প্রতিও তাঁর অনুরাগ ছিল উল্লেখযোগ্য। নিজে আক্ষরিক শিক্ষা না-পেলেও বিদ্যা ও বিদ্বানের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। নিজামউদ্দিন, বীরবর, ভানুচন্দ্র, হরিবিজয়, আবুল ফজল, ফৈজী প্রমুখ বহু দিকপাল পণ্ডিত তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যের উন্নতির জন্যেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরই আদেশে ‘কথাসরিৎসাগর’ , ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ , ‘অথর্বব্দে’ প্রভৃতি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। হিন্দু ও পারসিক রীতির সংমিশ্রণে গঠিত বিভিন্ন হর্ম্যাদি (প্রাসাদ) আকবরের শিল্পানুরাগের পরিচয় দেয়।
এইভাবে সাম্রাজ্যের সংগঠন, ধর্মীয় উদারতা ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের মাধ্যমে আকবর যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তাতে তাঁকে ‘মহান’ উপাধি দেওয়া অবশ্যই যুক্তিযুক্ত হয়েছে। ঈশ্বরীপ্রসাদের ভাষায় বলা যায়: “সার্বিক বিচারে আকবরকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শাসকদের অন্যতম বলা যায়। মহান ও মৌলিক বিচক্ষণতা, সর্বজনীন সহিষ্ণুতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং দৃঢ় রাষ্ট্রবিদসুলভ প্রতিভা ও তাঁর এই দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে” (“All things considered he will rank among the greatest kings of history, and his claim to this prominent position will always rest upon his grand and original intellect, universal toleration force of character and the solid results of his statesmanship.”)।