সাম্প্রদায়িকতা ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ রচনা - পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান পাঠক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষায় একটি করে প্রবন্ধ রচনা প্রশ্নপত্রে এসেই থাকে। শব্দসীমা ৫০০ এবং পূর্ণমান ১০। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কোনো উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে না কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে। এই নমুনা বাংলা প্রবন্ধরচনা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে আমরা মধ্য বিভাগের সকল শ্রেনীর বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রদান করবো। নতুন নতুন প্রশ্ন পেতে নিয়মিত আমাদের Website টি Follow করো।যাইহোক, বর্তমান পোস্টে প্রকাশিত “সাম্প্রদায়িকতা ও তার প্রতিকার” প্রবন্ধটি মূলত মাধ্যমিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রদায়িকতা ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা:
“শতাব্দীর সূর্য রক্তমেঘমাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী ভয়ংকরী।”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বাধীনতা লাভের পর অনেক বছর কেটে গেল। তবু ভারতবর্ষের বুকে নতুন করে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার জিগির শুরু হয়েছে। সম্প্রতি পরপর এমন কতকগুলি ঘটনা আমাদের সামনে ঘটে গেল যা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শান্তিপ্রিয় মানুষকে বিব্রত করে তুলেছে।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস’ কিংবা গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত ও অসহায় করে তুলেছে। সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতা উদগ্র মূর্তিতে প্রকাশিত হয়ে ভারতের ঐক্য ও সংহতিকে বিপন্ন করে তুলেছে। দেশের চিন্তাশীল শক্তিকামী মানুষদের মতো ছাত্রসমাজও ভারতবর্ষের বুকে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের এই অবাধ রাজত্বে আতঙ্কিত।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার নজির:
‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ লক্ষ করা যায়। মানুষের মধ্যে পার্থক্য অনেকখানি। তবুও ভারতে এক সময় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ছিল অটুট। কিন্তু আজ মানুষের মানবিকতার অবনমনের ফলে বহু রক্ত ঝরেছে ভারতের মাটিতে। হিন্দু-মুসলমান, আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আজ ভারতে রক্ত কলঙ্কিত ইতিহাস রচিত হয়েছে।
বিশ্বে যেখানে ইতিহাসের বিচিত্র উপকরণের মাত্রা অনেক বেশি, সেখানে অজ্ঞতার অভিশাপে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও তত বেশি। সাম্প্রদায়িকতার জেরে দেখা গেছে হিংসার করাল গ্রাস। বিবদমান গোষ্ঠীগুলি রক্ত নিয়ে মেতে উঠেছে নৃশংস হোলি খেলায়।
সাম্প্রদায়িকতার মৌল কারণ:
মানুষের লোভ, লালসা, ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের মোহই সাম্প্রদায়িক হানাহানির মৌল কারণ। আমাদের ছাত্রসমাজকে তার নবলব্ধ জ্ঞানগরিমা ও যুক্তিনির্ভর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্যস্থতায় সমস্যার মূল গভীরে প্রবেশ করতে হবে এবং আবিষ্কার করতে হবে উপযুক্ত সমাধান সূত্র।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ:
সাম্প্রদায়িকতাকে মানবতা বিরোধী অসুরের সঙ্গে। তুলনা করা যেতে পারে। আপাতভাবে এর প্রকাশ নানারকম। ভারতবর্ষে নানা ধর্ম, নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ-সংঘর্ষ ঘটেছে বহুবার। এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় মাঝে মাঝে পৃথিবীর নানা স্থানে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা হয়েছে।
“বীভৎস চিৎকারে তারা দিবারাত্রি করে ফেরাফেরি
নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।”
এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মূলে আছে মানুষের সংকীর্ণ ধর্মভাবনা বা ধর্মান্ধতা। এখন ভারতবর্ষে বর্ণগত ভেদবৈষম্যও ভয়ংকর আকার নিয়েছে। আজও বিহার কিংবা দক্ষিণ ভারতে হরিজন সম্প্রদায়কে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। উপজাতীয় মানুষেরা উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা অবহেলিত হচ্ছে। প্রাদেশিক সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে অহরহ।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশে মারাত্মকভাবে নেমে এসেছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার করাল হিংসা। প্রতিটি পদে তাকে ইন্ধন যোগানো হচ্ছে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য।
সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপকতা ও তার কারণ:
সাম্প্রদায়িকতা এক দুরারোগ্য ব্যাধি। এই সংক্রামক ব্যাধি জাতির জীবনে গভীরে প্রোথিত। শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলার কঠোরতার মধ্যে তার সমাধান সূত্র নেই। স্বার্থান্ধ মানুষের দল বারবার এই ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছে। দেশের দরিদ্র, মূর্খ মানুষকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। বর্ণপ্রেম ও জাতিপ্রেমের জিগির তুলে তারা মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। ইংরেজের বাণিজ্যবুদ্ধি ভারতের দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়েছিল।
দেশবিভাগের নেপথ্যে থাকল ইংরেজদের দুরভিসন্ধি। দেশের মূল জীবনপ্রবাহের যে শিক্ষা সেখানেও জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও উগ্রতা।
সাম্প্রদায়িকতা ও ছাত্রসমাজ:
একটি রাষ্ট্রের গঠন ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষিত হয় সেই রাষ্ট্রের ছাত্রসমাজের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। সাম্প্রদায়িকতার নির্মম লজ্জাজনক মারণবীজকে ছিন্নমূল করার ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার দুষ্টচক্রে পা দেবে না।
সাম্প্রদায়িকতা মানুষের হৃদয়কে বিষবৃক্ষের ফল খাওয়ার মতো দহন করে। তাই এর বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে গড়ে তুলতে হবে তীব্র প্রতিরোধ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের সংগ্রামী চেতনা জাগিয়ে তোলার জন্য শিক্ষা পদ্ধতির সাহায্য দরকার। জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে রুখতে হলে ছাত্রসমাজকে জাতীয় সম্প্রীতির লক্ষ্যে উপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতির দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
দেশের সর্বস্তরের সামাজিক মানুষ কে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তবেই সকলের সমবেত চেষ্টায় এ বীজ উৎপাটিত হবে।
প্রতিকারের উপায়:
(১) বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণির মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
(২) জাতিধর্মবর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মিলনের মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে।
(৩) বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, হরিজন, পার্বত্য উপজাতির মানুষদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন না করে তাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মূল্য দিতে হবে।
(৪) রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ত্যাগ করে মানুষকে আদর্শপ্রবণ হতে হবে।
(৫) নানান ধর্মের, সম্প্রদায়ের ছাত্রদের মধ্যে পারস্পরিক মিলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।
(৬) কেবল অনুন্নত সম্প্রদায়ের সঙ্গে মেলমেশা করলেই হবে না, তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা দিতে হবে। জাতীয় ও সামাজিক নানাবিধ উন্নয়নকল্পে তাদের অগ্রবর্তী করে তুলতে হবে-
“ডাকিয়া বলিতে হবে-
মুহূর্তে তুলিয়া শির একত্রে দাঁড়াও দেখি সবে।”
উপসংহার:
সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বাতাস ভারতের ঐক্য ও সংহতির সুমহান ঐতিহ্যকে বিষাক্ত করতে উদ্যত। এই অশুভ শক্তিকে দমন করার জন্য নবীন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতের ইতিহাসে দেখা গেছে গোপন হিংসা কপট রাত্রি ছায়ে। তাই সকল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষকে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বাণী কণ্ঠে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন-
Note: পোস্ট টি অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এ শেয়ার করুন। যদি কোন ভুল থেকে থাকে তবে তা Typing mistake এর জন্য। আমাদের comment করে জানান আমরা তা সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করবো।