নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল || Equatorial Climate Zone - সুপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আজকের এই পর্বটিতে আমরা শেয়ার করলাম নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল, নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ, নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
নিরক্ষীয় অঞ্চল কী
নিরক্ষীয় উয় ও আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে সারা বছর অত্যধিক উষ্ণতা আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে গভীর অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে। এইকারণে এই অঞ্চলকে নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য অঞ্চল (Equatorial Rain Forest Region) বলা হয়।
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের অবস্থান
নিরক্ষরেখার দুই পাশে সাধারণত ৫ °- ১০ ° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলে এই জলবায়ু দেখা যায়।
আফ্রিকার কঙ্গো বা জাইরে নদীর অববাহিকা; দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী অববাহিকা; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনস; ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ; শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ অংশ; কলম্বিয়ার পশ্চিম উপকূল; মাদাগাস্কারের পূর্বাংশ; মধ্য আমেরিকার পানামা, কোস্টারিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কিছু অঞ্চল এই জলবায়ুর অন্তর্গত।
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য
উষ্ণতা - এই অঞ্চলে সারাবছর সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়ে। ফলে উন্নতা সবসময়ই বেশি (বার্ষিক গড় উয়তা ২৭ ° সেলসিয়াস)। বার্ষিক উন্নতা থাকে ২৫ ° সেলসিয়াস থেকে ৩০ ° সেলসিয়াস। বার্ষিক উন্নতার প্রসর হয়। মাত্র ২ ° সেলসিয়াস থেকে ৩ ° সেলসিয়াস। সেইসঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতাও বেশি থাকে। তবে রাতে উন্নতা বেশ কমে যায় (২৫ ° সেলসিয়াস), তাই নিরক্ষীয় অঞ্চলে রাত্রিক্রান্তীয় শীতকাল (Winters of tropics) নামে পরিচিত। সারাবছর ধরে দিন ও রাতের পরিমাণ প্রায় সমান থাকে (১২ ঘন্টা)। এত কম বার্ষিক উয়তার প্রসর পৃথিবীর আর কোনো জলবায়ু অঞ্চলে দেখা যায় না।
বৃষ্টিপাত - সারাবছর বেশি উন্নতার কারণে এই অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপ অবস্থান করে। এই অঞ্চলে স্থলভাগের থেকে জলভাগের পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রচুর জলীয়বাষ্প বাতাসে মেশে। এই উষু আর্দ্র বাতাস উর্ধ্বাকাশে উঠে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে পরিচলন প্রক্রিয়ায় (Convectional rain) প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় (বার্ষিক ২০০ সেমি. - ২৫০ সেমি.)।
মোট বৃষ্টিপাতের দিনসংখ্যা বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ হয়। প্রায় প্রতিদিন সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকে। বিকেলের দিকে ৩-৪টের সময় ঘন কিউমুলোনিম্বাস মেঘে আকাশ ঢেকে যায়। বজ্র বিদ্যুৎসহ প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়। তাই একে 4 O'clock rain বলে। আবার রাত্রিবেলা আকাশ মেঘমুক্ত হয়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। এই জলবায়ু অঞ্চল নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় অর্থাৎ আন্তঃক্রান্তীয় অভিসরণ অঞ্চল (ITCZ) দ্বারা প্রভাবিত।
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের জীববৈচিত্র
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ -
এই অরণ্যে সারা বছর গাছে সবুজ পাতা থাকে, ফুল ফোটে, ফল ধরে, তাই চিরসবুজ অরণ্য (Evergreen forest) বলা হয়। ব্রাজিলের আমাজন নদী অববাহিকায় এই ক্রান্তীয় অরণা ‘ সেলভা নামে পরিচিত। এই অরণ্যে রবার, রোজউড ব্রাজিল নাট, আয়রন উড়, বাঁশ গাছ দেখা যায়। জাইরে (কঙ্গো) নদী অববাহিকার নিরক্ষীয় তারণ্যে মেহগনি, রবার, পাম, কোকো, সিঙ্কোনা গাছের প্রাধান্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরক্ষীয় অরণ্যে শাল, সেগুন, আবলুস, রবার গাছ দেখা যায়। উপকূল অঞ্চলে প্রচুর নারকেল, তালগাছ জন্মায়।
এই অরণ্যে নানা প্রজাতির গাছ পাশাপাশি জন্মায়।। ব্রাজিলের বৃষ্টি অরণ্যে ২ বর্গকিমি অঞ্চলে গড়ে প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছ দেখা যায়। পৃথিবীর আর কোনো অরণ্যে এত প্রজাতির গাছ দেখা যায় না। গাছগুলোর কাঠ শক্ত ও ভারী, গুড়ি খুব লম্বা, মোটা আর পাতাগুলো বেশ চওড়া হয়। গাছগুলো এমন ঠাসাঠাসিভাবে থাকে, যে অরণ্যের ওপর চাঁদোয়ার (Canopy) মতো ঢেকে যায়। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো অরণ্যের তলদেশে পৌঁছোতে পারে না। ফলে স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার তলদেশে নানা লতা, গুল্ম, পরগাছা গজিয়ে দুর্গম হয়ে ওঠে।
বন্যপ্রাণ - ঘন ও দুর্ভেদ্য অরণ্যে, গাছে চড়তে পারে এমন পশুপাখি, জীবজন্তুর আধিক্য। বাঁদর, গরিলা, শিম্পাঙ্খি, ওরাংওটাং, বিভিন্নরকম সাপ, পাখি, বিষাক্ত কীটপতঙ্গ দেখা যায়। অরণ্যের তলদেশে হরিণ, গন্ডার, হাতি, জেব্রা ও নদী, জলাশয়ে প্রচুর কুমির, জলহস্তী রয়েছে।
নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও জীবনযাত্রা
অধিবাসী জীবনযাত্রা - উষ্ণ আর্দ্র অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু, বিপদসংকু বন্যপরিবেশে জনবসতি নিরল। জাইরে ও আমাজন অববাহিকার তুলনায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরক্ষীয় অঞ্চলে লোকবসতি বেশি। জাইরে অববাহিকার পিগমি, উচ্চ আমাজন অববাহিকার রেড ইন্ডিয়ান ও দক্ষি - পূর্ব এশিয়ার সম ও অন্যান্য উপজাতির মানুষরা এই অঞ্চলের প্রধান অধিবাসী। বনের ফলমূল, কাজসম্পদ সংগ্রহ ও পশুশিকার অধিবাসীদের প্রথম জীবিকা।
বর্তমানে অরণ্যের কাছাকাছি অঞ্চলে আদিম প্রথায়, স্থানা। কৃষির মাধ্যমে ভুট্টা, মিষ্টি আলু, ওল, কলার চাষ হচ্ছে। কোথাও কোথাও স্থায়ীভাবে কৃষিকাজ করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপীয় বণিকরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ' বাগিচা কৃষি ' শুরু করেছিল। দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার মালয়, জাভা, সুমাত্রায় রবার চাষ, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আখ, কলার চাষ; আফ্রিকার গিনি উপকূলে কোকো ও তাল (পাম) জাতীয় গাছের তেল উৎপাদন করে অধিবাসীরা জীবিকা নির্বাহ করে।
খনিজ সম্পদ, শিল্প - মালয় এ টিন, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও-য় প্রচুর খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি। তবে স্থানীয় কৃষিজ, বনজ ও খনিজ দ্রব্যের ওপর নির্ভর করে কিছু শিল্প গড়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক অবস্থা - অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু, দুর্গম জগল, বিষাক্ত কীটপতঙ্গের উপদ্রব, ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব সবই এখানকার অর্থনৈতিক উন্নতির অন্তরায়। কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলে নতুন জনবসতি গড়ে উঠছে। ক্রমাগত চাহিদায়, বসতি, কৃষি, শিল্প, পরিবহন এর প্রয়োজনে প্রতিদিন বিরাট এলাকার বৃষ্টি অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালে ট্রান্স-আমাজন হাইওয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চল বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।
আরও পড়ুন - মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চল