ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল || Mediterranean Climate Zone PDF : সুপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আজকের এই পর্বটিতে আমরা শেয়ার করলাম ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল সম্পর্কে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য, কোন বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে শুষ্ক থাকে ইত্যাদি।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল কাকে বলে?
উষ্ণ নাতিশীতোয় মণ্ডলের বিশিষ্ট জলবায়ু অঞ্চল হলো ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল। শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো ছাড়াও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর মতো জলবায়ু দেখা যায় তাকেও ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল বলা হয়।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে ৩০° - ৪৫° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত মহাদেশের পশ্চিমদিকে এই জলবায়ু দেখা যায়।
ইউরোপের ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন গ্রিস, পোর্তুগাল, আলবেনিয়া, পূর্বতন যুগোশ্লোভিয়া ; এশিয়ার তুরস্ক, ইসরায়েল, সিরিয়া, লেবানন এবং আফ্রিকার মিশর, মরক্কো, লিবিয়া, আলজিরিয়া, টিউনেশিয়া -এই ১৬ টি দেশে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর সর্বাধিক প্রভাব দেখা যায়।
এছাড়া উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বে এই জলবায়ু দেখা যায়।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য
সারাবছর মৃদুভাবাপন্ন নাতিশীতোয় জলবায়ু, শুষ্ক গ্রীষ্মকাল এবং শীতকালীন বৃষ্টিপাত ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর উন্নতা:
গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা ২১° - ২৭° সেলসিয়াস, তবে শীতকালে তা কমে ৫° - ২৭° সেলসিয়াস হয়। অর্থাৎ বার্ষিক তাপমাত্রার প্রসর থাকে ১৭° সেলসিয়াস। গ্রীষ্মকালে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চচাপ বলয় অবস্থান করে। ফলে স্থলভাগ থেকে শুষ্ক আয়ন বায়ু সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। একারণে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি হয় না। আকাশ মেঘমুক্ত, রোদ ঝলমলে থাকায় রাতে তাপমাত্রা কমে যায়।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর বৃষ্টিপাত-
শীতকালে এই অঞ্চল থেকে উচ্চচাপ বলয় সরে গেলে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রবাহিত জলীয় বাষ্পপূর্ণ পশ্চিমাবায়ু এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৫ সেমি -১৫০ সেমি। অ্যাড্রিয়াটিক উপসাগরের পূর্ব উপকূলে বৃষ্টির পরিমাণ সবথেকে বেশি হয়। উপকূল থেকে ভিতরের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় বলে, এই অঞ্চলকে। শীতকালীন বৃষ্টিপাতের দেশ বলে।
এই অঞ্চলে তুষারপাত বিশেষ হয় না তবে ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূল অঞ্চলে, ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যভাগে অল্প তুষারপাত হয়।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য:
শুষ্ক গ্রীষ্ম এবং আর্দ্র শীতকালের কারণে এই জলবায়ু অঞ্চলে চিরসবুজ গাছ এবং গুল্মজাতীয় গাছের মিশ্র বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে। শুষ্ক গ্রীষ্মকালে বাষ্পীভবন আটকাতে গাছের পাতা পুরু ও কান্ড শক্ত হয়। বড়ো বড়ো পাতা, পুর ছালযুক্ত গাছগুলো শীতকালের বৃষ্টির জল সঞ্চয় করে রাখে। প্রধানত তিন ধরনের স্বাভাবিক উদ্ভিদের সমাবেশ এখানে দেখা যায়–
1. সরলবর্গীয় উদ্ভিদ–পাইন, ফার, সিডার
2. চিরসবুজ উদ্ভিদ–ওক, কর্ন, ইউক্যালিপটাস, রোজউড।
3. গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ- ম্যাপল, লরেল, রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার।
জলপাই গাছ ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অন্যতম প্রধান উদ্ভিদ। এই জলবায়ু অঞ্চলে পৃথিবীর সবথেকে বেশি জলপাই গাছ রয়েছে।
প্রাণীজগৎ ও পশুপালন- বৃষ্টিহীন শুষ্ক গ্রীষ্মকাল ও আর্দ্র শীতকালের কারণে এখানে তৃণভূমির পরিমাণ কম। তাই ঘোড়া বা গবাদি পশুর তুলনায় গাধা, ভেড়া, ছাগল, খচ্চর বেশি পালিত হয়। উষ্ণ মরুর কাছাকাছি অঞ্চলে মুরগি, উট বেশি পালিত হয়।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও জীবনযাত্রা
কৃষিকাজ: নাতিশীতোয় জলবায়ু, মাঝারি বৃষ্টিপাত এই অঞ্চলকে কৃষিকাজে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে। প্রধান উৎপাদিত ফসল গম। এছাড়া যব, তুলা, ভুট্টা, ধান, তামাক, সবজি উৎপাদিত হয়। তুঁত গাছের প্রাচুর্য এই অঞ্চলে রেশম শিল্প গড়ে তুলেছে।
ঝলমলে, মনোরম আবহাওয়ায় এই অঞ্চলে প্রচুর মূল্যবান ফল, যেমন– আঙুর, জলপাই, আপেল, ন্যাসপাতি, কমলালেবু, পিচ, খুবানি, আখরোট, বাদাম, কল, ডুমুর ও নানা ধরনের লেবু প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। একারণে এই অঞ্চলকে ফলের ঝুড়ি বলা হয়।
খনিজসম্পদ ও শিল্প:
এই অঞ্চল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় খনিজ তেল, ফ্রান্সে বক্সাইট, ইতালিতে মার্বেল, গন্ধক; স্পেনে লোহা পাওয়া যায়।
অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চল উন্নত। কৃষিকাজ, ফলের চাষ এবং ফলভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প, রপ্তানি ব্যবসা বাণিজ্য প্রধান জীবিকা। ইতালি, ফ্রান্সে আঙুর থেকে উৎকৃষ্ট মদ, জলপাই থেকে অলিভ অয়েল তৈরির শিল্প প্রসিদ্ধ। এগুলো সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করা হয়। অন্যান্য শিল্পের মধ্যে কাঁচা ফল, শুকনো ফল, ফলজাত দ্রব্য (জ্যাম, জেলি, আচার), ময়দা শিল্প প্রভৃতি প্রধান।
মনোরম, রোদ ঝলমলে আবহাওয়ার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র শিল্প কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
জনবসতি- মনোরম, স্বাস্থ্যকর জলবায়ু, উন্নত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, জীবিকা নির্বাহের সহজ সুযোগের কারণে এই অঞ্চল জনবহুল এবং অধিবাসীরা অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই অঞ্চলেই অতীতে গ্রিক, মিশরীয় ও রোমান সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস্ অ্যাঞ্জেলস, সান ফ্রান্সিসকো, ইতালির রোম, নেপলস্, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড, পোর্তুগালের লিসবন এই অঞ্চলের প্রধান নগর, বন্দর ও শিল্পকেন্দ্র।
আরও পড়ুন-