মৌসুমী বায়ুর উৎপত্তি
আরবি শব্দ 'মৌসিম' এর অর্থ ‘ঋতু’। মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের অবস্থান:
উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ১০ থেকে ৩০ ° অক্ষাংশে মহাদেশের পূর্বে অবস্থিত দেশগুলোতে মৌসুমী জলবায়ু দেখা যায়। এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, কাম্পুচিয়া, দক্ষিণ চিন এবং ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের কিছু অংশে মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব দেখা যায়। এছাড়াও পূর্ব আফ্রিকার সোমালি, মাদাগাস্কার; উত্তর অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের কিছু অঞ্চলে এই জলবায়ু অনুভূত হয়।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য
শীত ও গ্রীষ্মে বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ, উদ্বু - আর্দ্র গ্রীষ্মকাল, শুষ্ক শীতকাল মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোতে প্রধান চারটে ঋতু লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশ এই জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত।
শীতকাল (নভেম্বর- জানুয়ারি) : গড় তাপমাত্রা সাধারণত ২৫° সেলসিয়াস। উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু' রূপে প্রবাহিত হয়। এর প্রভাবে সারা ভারতে বৃষ্টি না হলেও করমণ্ডল উপকূল, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং শ্রীলঙ্কায় বৃষ্টি হয়। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার জন্য উত্তর পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু অংশে তুষারপাত হয়।
প্রাক-মৌসুমী গ্রীষ্মকাল (মার্চ - মে) : গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ৩০° সেলসিয়াস। তবে তাপমাত্রা ৩৮ ° সেলসিয়াস - এর বেশি হয়। অত্যধিক উন্নতার কারণে স্থলভাগের ওপর নিম্নচাপ তৈরি হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ, অসম, মায়ানমারে কিছুটা বৃষ্টি হয়।
বর্ষাকাল (জুন-সেপ্টেম্বর): আরবসাগর ও বঙ্গোপোসাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই আকস্মিক ও প্রচন্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়। একে মৌসুমী বায়ুর বিস্ফোরণ (Burst of Monsoon) বলা হয়। এই সময় বাতাসে সর্বাধিক জলীয় বাষ্প থাকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০০-৩০০ সেমি। মৌসিনরামে বছরে গড়ে ১২০০ সেমি বৃষ্টিপাত হয়। তবে মৌসুমী বৃষ্টি খুবই অনিশ্চিত। ফলে খরা ও বন্যা হওয়ার প্রবণতা থাকে।
শরৎকাল (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) : মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে আবহাওয়া ধীরে ধীরে শীতকালীন অবস্থার দিকে পরিবর্তিত হয়। বঙ্গোপোসাগরে গভীর নিম্নচাপ তৈরি হলে বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড় ও বৃষ্টি হয়।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ :
নিরক্ষীয় জলবায়ুর মতো গভীর চিরসবুজ অরণ্য এই জলবায়ুতে দেখা যায় না। প্রধানত পর্ণমোচী (শুষ্ক শীতকালে গাছের পাতা ঝরে যায়) প্রকৃতির উদ্ভিদের প্রাধান্য হলেও বৃষ্টিপাতের তারতম্য অনুসারে বনভূমির প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়।
যেসব অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত খুব বেশি (২০০ সেমি), সেখানে শুষ্ক ঋতুতেও মাটি ভেজা থাকায় মেহগনি, শিশু, গর্জন -এর চিরসবুজ বনভূমি সৃষ্টি হয়।
মাঝারি বৃষ্টিপাতযুক্ত (বার্ষিক (১০০-২০০ সেমি) অঞ্চলে শাল, সেগুন, শিমুল, পলাশ, শিরিষ, মহুয়া, আম, কাঁঠাল জাতীয় পর্ণমোচী বৃক্ষের মিশ্র বনভূমি দেখা যায়। শুষ্ক অঞ্চলে (বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৫০-১০০ সেমি) ফণীমনসা, বাবলা, ক্যাকটাস জাতীয় কাঁটাগাছের ঝোপঝাড় দেখা যায়। উপকূল অঞ্চলে সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া গাছের ম্যানগ্রোভ অরণ্য দেখা যায়।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের বন্যপ্রাণ :
হাতি, গণ্ডার, চিতা, হরিণ, নেকড়ে, ভালুক, বানর, শিয়াল, হায়না, সাপ ছাড়াও বিশেষ অঞ্চলে বাঘ (সুন্দরবন), সিংহ (গুজরাটের গির অরণ্য) উপকূলের নদী মোহনায় কুমীর, নদী ও জলাশয়ে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও জীবনযাত্রা
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের কৃষিকাজ -
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধান ও পাট উৎপাদক অঞ্চল। অনুকূল জলবায়ু, উর্বর মাটির জন্য এই অঞ্চল কৃষিকাজে অত্যন্ত উপযুক্ত। ধান, পাট, গম আখ, তুলা, তৈলবীজ, চা, কফি, রবার এই অঞ্চলের প্রধান কসল। এছাড়া আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, আনারস, পেয়ারা প্রভৃতি ফল উৎপাদনেও এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের খনিজসম্পদ ও শিল্প -
এই জলবায়ু অঞ্চল খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। কয়লা, লোহা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, খনিজতেল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বড়ো শিল্পের মধ্যে পাট শিল্প, কার্পাসশিল্প, চা শিল্প, লৌহ-ইস্পাত শিল্প প্রধান।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা -
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের অধিকাংশ ভূপ্রকৃতি সমতল। তাই সড়ক, রেল, জলপথ ও আকাশপথ সব ধরনের পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের জনবসতি -
অনুকূল জলবায়ু উর্বর মাটি, সমৃদ্ধ কৃষিকাজ, উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার কারণে মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চল পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল অঞ্চল। দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, সাংহাই, ঢাকা, রেঙ্গুন, ব্যাংকর, নমপেন -এর মতো বড়ো বড়ো জনবহুল শহর রয়েছে এই অঞ্চলে।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা -
অনুকূল জলবায়ু, কৃষিজ, বনজ ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় এই অঞ্চলে উন্নত পরিকাঠামো, প্রযুক্তি, আধুনিক শিল্পস্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে।
আরও পড়ুন - নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল
Sir pdf din
ReplyDelete