সংস্কারক হিসেবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর কৃতিত্ব সম্পর্কে আমাদের এই পোস্ট এ সম্পুর্ণ আলোচনা করা হল। সংস্কারক হিসেবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর কৃতিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন যার উত্তর সকল ছাত্রছাত্রীদের জানা প্রয়োজন। তাই আর দেড়ি না করে নিচে দেওয়া বেন্টিঙ্কের সংস্কারগুলি মনযোগ সহকারে পড়ুন।
সংস্কারক হিসেবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর কৃতিত্ব নিরূপণ করো। (Narrate the achievements of Lord William Bentinck as a reformer.)
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর শাসনকাল (১৮২৮-৩৫ খ্রিঃ) নানা কারণে ভারতবর্ষের ইতিহাসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর উদারতা, আন্তরিকতা ও মানবিকতা প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর কাজকর্মের মধ্য দিয়ে। বেন্টিঙ্কের প্রশংসা করে ঐতিহাসিক মজুমদার বলেছেন, “ তাঁর সাত বছরের শাসনকাল ছিল শান্তি, মিতব্যয়িতা এবং সংস্কারের যুগ " (" William Bentincks Seven Year's rule was an era of peace, retrenchment and reforms .")।
ব্রিটিশ আমলা মেকলে বেন্টিঙ্কের কাজের প্রশংসা করে বলেছেন, “ তিনি প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরতন্ত্রের মাঝে ব্রিটিশ স্বাধীনতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন " (" Infused into oriental despotism the spirit of British freedom .")
হিতবাদী দর্শনের প্রভাব:
অনেকের মতে, বেন্টিঙ্ক ‘হিতবাদী’ মতাদর্শ (utilitarianism) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে এই মতাদর্শ ইংল্যান্ডেপ্রচারিত হয়। এর প্রবক্তা ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বেন্থাম। হিতবাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক মানুষের সর্বাপেক্ষা অধিক উপকার। এই তত্ত্বের সমর্থকগণ অন্যান্য সবদিক উপেক্ষা করে কেবলমাত্র উপযোগিতার ভিত্তিতে কাজের ন্যায়-অন্যায় বিচার করত।
বেন্টিঙ্ক এই মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে সংস্কারসাধনে আন্তরিক হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভা এবং বোর্ড অব্ কন্ট্রোলের সভাপতিও জনকল্যাণমূলক সংস্কারে ব্রতী হতে বেন্টিঙ্ককে উৎসাহিত করেছিলেন। তাই বলা চলে যে, ইংল্যান্ডের নতুন দর্শন, জনমত মন্ত্রিসভার পরিবর্তিত মনোভাব প্রভৃতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বেন্টিঙ্ক ভারতে সংস্কারকার্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
অর্থনৈতিক সংস্কার:
বেন্টিঙ্ক যখন ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন কোম্পানির বাৎসরিক দশ লক্ষ টাকা ঘাটতি চলছিল।
ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের ফলেই এই আর্থিক বিপর্যয় ঘটেছিল। তাই প্রথমেই তিনি সামরিক ও বেসামরিক খাতে ব্যয়সংকোচ করতে নির্দেশ দেন। সৈনিকদের যুদ্ধকালীন ‘অর্ধভাতা’ (Half Batta) বন্ধ করা হয় এবং সামরিক কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করা হয়।
বহু নিষ্কর জমি তিনি করযোগ্য ঘোষণা করেন। আগ্রা এলাকায় নতুনভাবে জমি বণ্টন করে বর্ধিত হারে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। বাণিজ্য-আয়। বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বেন্টিঙ্ক কোম্পানিকৃত একচেটিয়া আফিং ব্যবসায়ের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করেন।
বেন্টিঙ্কের এইসব কঠোর ব্যবস্থার ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। অবশ্য কঠোর হাতে তিনি তাদের নিয়ন্ত্রিত করেন। তাঁর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাদির ফলে কোম্পানির আয় দশ লক্ষ টাকা ঘাটতির পরিবর্তে পনেরো লক্ষ টাকা উদবৃত্তে পরিণত হয়েছিল।
প্রশাসনিক ও বিচার-সংস্কার:
বেন্টিঙ্ক সাধারণ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে কয়েকটি পরিবর্তনসাধন করেন। যেমন-
(১) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরদের কাজ একই ব্যক্তির হাতে অর্পণ করা হয়।
(২) কয়েকটি জেলা নিয়ে একটি করে বিভাগ (Division) সৃষ্টি করা হয়। প্রতি বিভাগে একজন করে কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। এঁরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজের তদারক করতেন।
(৩) বেন্টিঙ্ক কর্নওয়ালিশ-প্রবর্তিত প্রাদেশিক আপিল আদালত ও ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলি তুলে দেন। জেলা জজদের নাম পরিবর্তন করে ‘ সেসন জজ ' রাখা হয়। এঁদের হাতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব অর্পিত হয়।
আরও পড়ুন- সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগরের অবদান
(৪) গ্রামীণ আদালতগুলিকে নিয়মিত আদালতের মর্যাদা দেওয়া হয়।
(৫) তিনি উচ্চ আদালতে ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের এবং নিম্ন আদালতে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের নিয়ম চালু করেন। ফলে বিচারকাজ সাধারণ মানুষের বোধগম্য হতে পারে।
(৬) ভারতের বিশালতার কথা চিন্তা করে তিনি এলাহাবাদে একটি সর্বোচ্চ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেন।
(৭) দেওয়ানি মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতীয় বিচারপতি নিয়োগের নির্দেশ দেন এবং এঁদের পদমর্যাদা ও বেতন বৃদ্ধি করেন।
পেনাল কোড:
এতকাল পর্যন্ত ভারতের শাসনব্যাপারে কতকগুলি বিধি বা Regulation ছিল মাত্র, কোনো বিধিবদ্ধ আইন ছিল না। বেন্টিঙ্কের আমলে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ‘ চার্টার আইন পাস হয়। ফলে গভর্নর-জেনারেলের পরিষদে একজন ‘আইন সদস্য’ (Law member) নিযুক্ত হন। লর্ড মেকলে এই পদে নিযুক্ত হন। বেন্টিঙ্ক মেকলের নেতৃত্বে একটি ‘ আইন কমিশন ' (Law Commission) গঠন করে ভারতীয় আইনবিধি সংকলনের দায়িত্ব দেন।
এইভাবে মেকলের নেতৃত্বে ভারতীয় আইনবিধি বা ' ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ' (Indian Penal Code) বিধিবদ্ধ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেন্টিঙ্ক যোগ্যতানুযায়ী ভারতীয়গণকে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন।
সতীদাহ নিবারণ:
বেন্টিঙ্কের যে কীর্তি ও কৃতিত্ব ভারতবাসীকে আপ্লুত করে রেখেছে, তা হল তাঁর সামাজিক সংস্কারসমূহ।
সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর দুটি অমর কীর্তি হল সতীদাহ-নিবারণ এবং ঠগী দমন। তখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতের বহু অঞ্চলেই ‘সতীদাহ’ নামক এক নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথানুযায়ী স্বামীর মৃত্যু ঘটলে স্ত্রীও স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতেন। সতী নারীরা, স্বেচ্ছায় এভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতেন বলে দাবি করা হলেও, আসলে জোর করেই জীবন্ত নারীদের পুড়িয়ে মারা হত।
আরও পড়ুন- কর্নওয়ালিশের শাসন ও বিচার-সম্পর্কীয় সংস্কারগুলি
লর্ড কর্নওয়ালিশের আমল থেকেই এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় ধর্মে হস্তক্ষেপ হবে এই ভয়ে ইংরেজগণ কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করছিল। লর্ড মিন্টোর আমলে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি ছাড়া সতীদাহ করা চলবে না। কিন্তু সরকারি চোখকে ফাঁকি দিয়ে সতীদাহ যথারীতিই চলছিল। যুক্তিবাদী বেন্টিঙ্ক এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন যে, সভ্যসমাজে এরূপ নিষ্ঠুর কাজ কেবল অমানবিক নয়, বেআইনিও। এই উদ্যোগে তিনি রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ শিক্ষিত ভারতবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পান। রক্ষণশীল হিন্দুরা তীব্র বিরোধিতা করলেও বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ সতীদাহ নিবারণ আইন ’ জারি করেন।
ঠগি দমন :
‘ঠগি’ দস্যুদের দমন ছিল তাঁর আর এক স্মরণীয় কীর্তি। ‘ঠগ’ (ঠক) বা ‘ঠগি’ নামক দস্যুরা সামান্য অর্থের জন্যও নিরীহ পথচারীদের হত্যা করত। অতর্কিত ভাবে পথচারীর গলায় ফাঁস পরিয়ে তাদের হত্যা করাই ছিল এদের রীতি। মুঘল যুগেও এদের উপদ্রব ছিল।
শোনা যায় ঔরঙ্গজেব কয়েকশ ঠগিকে হত্যা করে এদের উপদ্রব কিছুটা বন্ধ করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে আবার এদের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছিল। বেন্টিঙ্ক মেজর শ্লীম্যান-এর উপর এদের দমন করার ভার দেন। শ্লীম্যান কঠোর হস্তে এদের দমন করেন।
শিক্ষাসংস্কার:
বেন্টিঙ্কের আর একটি উজ্জ্বল কীর্তি হল এদেশের শিক্ষাসংস্কার। এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের জন্য তিনি অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ‘ চার্টার অ্যাক্টে ' ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এই টাকা ব্যয়িত হত প্রাচ্য-ভাষাশিক্ষার জন্য।
কিন্তু বেন্টিঙ্ক ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর আইন-সচিব লর্ড মেকলেও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। অবশ্য একশ্রেণির ভারতবাসী প্রাচ্য শিক্ষাবিস্তারের জন্য অধিক আগ্রহী ছিলেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সমর্থক লর্ড মেকলে একদা লিখেছিলেন, “ ..আমরা প্রজাদের এমনভাবে শিক্ষিত করে তুলব যে, তারা আরও ভালো শাসনের যোগ্যতা অর্জন করবে। সেদিন যদি আসে তো তা হবে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে গর্বের দিন।... ” প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি মেকলে খুব হীন ধারণা পোষণ করতেন।
একবার তিনি তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন, “ ইউরোপের যে-কোনো ভালো গ্রন্থাগারের একটিমাত্র তাক এ ভারতবর্ষ এবং আরবের সমস্ত সাহিত্যকে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। ” যাই হোক, বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে এক ‘ রেগুলেশন ’ জারি করে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের জন্য সরকারি অর্থব্যয়ের নির্দেশ দেন। ওই বছরেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মেডিকেল কলেজ।
এইভাবে বহুমুখী সংস্কারের দ্বারা লর্ড বেন্টিঙ্ক তাঁর হিতবাদী দর্শনকে কার্যকরী করেছিলেন। তাঁর আগ্রহেই ভারতবাসী পেয়েছিল যোগ্যতার মর্যাদা, সুগম হয়েছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার পথ, সমাজমুক্ত হয়েছিল শিশুহত্যা, সন্তানবিসর্জন, সতীদাহ, ঠগি প্রভৃতি বিবিধ অনাচার ও অত্যাচার থেকে।
তাই ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার যথার্থই বলেছেন, “ বেন্টিঙ্ক ভারতশাসন নীতিকে প্রজাহিতৈষণা ও পাশ্চাত্যকরণের পথে চালিত করেছেন।