ভারতীয় সমাজের উপর পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা করো। (Discuss in brief of western education on Indian Society.)
ভারতীয় সমাজের উপর পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলাফল সম্পর্কে আমাদের এই পোস্ট এ সম্পুর্ণ আলোচনা করা হল। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন যার উত্তর সকল ছাত্রছাত্রীদের জানা প্রয়োজন। তাই আর দেড়ি না করে নিচে দেওয়া ভারতীয় সমাজের উপর পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলাফল মনযোগ সহকারে পড়ুন।
অন্ধকার যুগের অবসান
কোনো কোনো পণ্ডিত অষ্টাদশ শতককে ভারত - ইতিহাসের ‘অন্ধকার যুগ ' (Dark Age) বলে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের ফলে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জীবনে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সূচনা ঘটেছিল, তার প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী।
ভারতবাসীর সামাজিক, ধর্মনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন নিমজ্জিত হয়েছিল গভীর অন্ধকারে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ। অথচ সেই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবহেলিত থাকার অনিবার্য ফলস্বরূপ ভারতবাসী ক্রমশ জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়তে থাকে। মুঘল আমলে যেটুকু প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল, একসময় তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।
টোল, পাঠশালা, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়ে পড়ে। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অযৌক্তিক আচার-অনুষ্ঠান আমাদের ধর্মজীবন তথা সমাজজীবনকে প্রায় অসহনীয় করে তোলে। তাই আক্ষরিক অর্থে না হলেও, এই সময়কে ভারতীয় জীবনের ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ’ বললে অত্যুক্তি হয় না।
তিনটি উদ্দেশ্য
তবে এই অষ্টাদশ শতকেই ভারতবর্ষে নবজীবনের পদধ্বনি শ্রুত হয়েছিল। এই নবজীবনের বার্তা বহন করে এনেছিল কিছু খ্রিস্টান মিশনারি এবং কিছু উদারহৃদয় প্রগতিবাদী ব্যক্তি। পরিশেষে বিস্তারিত হয়েছিল সরকারি দাক্ষিণ্য। এই তিনের সমন্বয়ে ভারতবর্ষে সূচনা ঘটেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার। মোটামুটিভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা - প্রবর্তনের পশ্চাতে তিনটি পৃথক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল, যথা-
(১) খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য যুক্তিবাদে ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে তাদের খ্রিস্টানধর্মের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। তাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনেকাংশ জুড়ে ছিল এদেশের ধর্মবিশ্বাস ও আচার - অনুষ্ঠানের সমালোচনা এবং খ্রিস্টধর্মের গুণকীর্তন।
(২) কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা চেয়েছিলেন কিছুসংখ্যক ভারতবাসীকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে এদেশে কোম্পানির শাসন পরিচালনার জন্য কিছু করণিক তৈরি করতে।
(৩) ব্যক্তিগতভাবে উদার ও মহৎ চরিত্রের কিছু মানুষ পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারের দ্বারা ভারতবাসীর সামগ্রিক কল্যাণ ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
যুক্তিবাদের উন্মেষ
ভারতবাসীর জীবনে পাশ্চাত্যশিক্ষার প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। অন্ধবিশ্বাস এবং যুক্তিহীন আচার - অনুষ্ঠানের অসারতা উপলব্ধি করার ফলে ভারতবাসীর সমাজজীবনে নানা পরিবর্তন ঘটেছিল।
সতীদাহ প্রথা, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন, নরবলি দেওয়া, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস এদেশের সমাজজীবনে যে অভিশাপ ডেকে এনেছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে তা বিদূরিত হবার পথ প্রশস্ত হয়।
পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের দ্বারা সনাতন হিন্দুধর্মকে স্বমহিমায় বিরাজমান হতে সাহায্য করে। মনে রাখা দরকার, ভারতীয় সমাজ ধর্মনির্ভর। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাপ্রণালী বহুলাংশে ধর্মীয় চিন্তাভাবনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
সেই ধর্মভাবনা যদি ভ্রান্ত হয়, তাহলে দৈনন্দিন জীবনের মাধুর্য ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। হয়েও ছিল তাই। কিন্তু পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ প্রচারিত হবার ফলে ভারতীয় যুক্তিবাদের বিকাশ সম্ভব হয়।
এইভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের জাতীয় জীবনের অভিশাপ মুছে দিয়ে, সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
সীমাবদ্ধতা
প্রসঙ্গত স্মরণীয়, অষ্টাদশ শতকে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ঘটলেও তার প্রসার ছিল খুবই সীমিত। আধুনিক শিক্ষাবিষয়ে গ্রামাঞ্চল ছিল খুবই অবহেলিত। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ঘটেছিল মূলত শহরাঞ্চলে। আবার শহরের সমস্ত শ্রেণির মানুষ এই শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় আসেনি।
বাস্তবে ইংরেজি শিক্ষা কেবলমাত্র মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এই মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজি শিক্ষাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী হননি।
বলা যেতে পারে, ব্যক্তিগত ভাবে উন্নতির সোপান হিসেবে এঁরা নিজেদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে আগ্রহী। ইংরেজি শিক্ষায় বঞ্চিত থাকার ফলে এই শিক্ষার তাৎক্ষণিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি।
অবশ্য এই কারণে পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতীয় জীবনকে আদৌ প্রভাবিত করেনি, -একথা বলা যাবে না। তবে এই প্রভাব ছিল কম ব্যাপক।
নব্যবঙ্গ আন্দোলন
সবাই না হলেও বেশ কিছু নব্যশিক্ষিত যুবক ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে ভারতীয় সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। পাশ্চাত্য জ্ঞান - বিজ্ঞানের প্রভাবে ওদের মন অন্ধ সংস্কারে ভরা হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই যুবকদল ‘নব্যবঙ্গ ' (Young Bengal) নামে খ্যাতিলাভ করে।
লুই ডিরোজিও’র নেতৃত্বে এই যুবকদল এদেশের পচনশীল রীতিনীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদে বিশ্বাসী এই যুবকেরা বিনা যুক্তিতে কোনো কিছু গ্রহণ করাকে অপরাধ বলে প্রচার করে।
এদের প্রভাবে সনাতন হিন্দুধর্মের বহু অনাচার দূর হয়েছিল। এরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি, শিক্ষালয়, চিকিৎসালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে প্রগতিবাদী হতে সাহায্য করে। এদের সততা, আদর্শবোধ ও দেশপ্রেম এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
জাতীয় চেতনার বিকাশ
পাশ্চাত্য শিক্ষা- প্রবর্তনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ফল ছিল ভারতবাসীর রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ। এতকাল ভারতবাসী তাদের জাতিগত ঐতিহ্য ও অধিকার সম্পর্কে অচেতন ছিল।
পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে ভারতবাসী আমেরিকা, ফ্রান্স, গ্রিস প্রভৃতি দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। ওইসব দেশের দৃষ্টান্ত আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।
আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ রামমোহন রায় সর্বপ্রথম ভারতবাসীর রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করে, তাই পরবর্তীকালে ভারতবাসীকে জাতীয় স্বার্থে সংগ্রামমুখী করে তোলে। প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় কংগ্রেস। ধীরে ধীরে শুরু হয় ভারতবাসীর জাতীয় সংগ্রাম।
সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ
পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগ গ্রহণ করে হিন্দু সম্প্রদায়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হবার ফলে একদিকে যেমন হিন্দু - সমাজ কুসংস্কারমুক্ত হতে পারে, অন্যদিকে তেমনি এই শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে হিন্দুরা অধিকাংশ সরকারি চাকুরি লাভ করতে পারে।
সরকারি চাকুরি পাবার ফলে হিন্দুদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, মুসলমান সম্প্রদায় পাশ্চাত্য শিক্ষাকে বর্জন করতে থাকে। মুসলমানগণ মুঘল শাসন তথা মুসলমান শাসনের পতনের জন্য ইংরেজদের দায়ী করত।
তাদের মতে, মুসলমানদের দুরবস্থার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী বিদেশি ইংরেজগণ। তাই মুসলমানেরা সতর্কিতভাবে ইংরেজদের সংস্পর্শ বর্জন করার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। এই ভ্রান্ত যুক্তির বশবর্তী হবার ফলে মুসলমানগণ অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন- সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগরের অবদান
সরকারি চাকুরি তাদের নাগালের বাইরেই থেকে যায়। এই ঘটনার পরিণতিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হতে থাকে। কালক্রমে এই ব্যবধান দুই সম্প্রদায়কে পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করে তোলে।
মুসলমানগণ হিন্দুদের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজের চাকুরি গ্রহণ করার জন্য তাদের কাছে হিন্দুরা ইংরেজের দোসর বলে পরিগণিত হতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের এই ব্যবধান কালক্রমে সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত হয়।
এইভাবে নেমে আসে ভারত-জীবনের সবথেকে বড়ো অভিশাপ। ইংরেজ শাসকগণও এই হিন্দু- মুসলমানের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শাসন ও শোষণকে কায়েম রাখতে সচেষ্ট হয়।
ভাবের আদানপ্রদান
পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে দেশের এবং বিদেশের ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সাথে ভারতবাসীর ভাবের আদানপ্রদান সম্ভব হয়। বহু ভাষাভাষী মানুষ অধ্যুষিত ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাবের আদানপ্রদান অসম্ভব ছিল। ভারতবাসী একটি জাতি হয়েও বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠী নিজ নিজ অঞ্চলের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ফলে সাংস্কৃতিক বিকাশ ও সমন্বয়ী ভাবধারার প্রসার রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষালাভ করার ফলে এই সীমাবদ্ধতা কেটে যায়। এমনকি বিদেশের ভাব-ভাবনাও আমাদের গোচরীভূত হতে থাকে। ফলে এক বিশ্ব সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব হয়।
এইভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসার ভারতবাসীর সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বয়ে আনে নবজীবনের ফল্গুধারা।