নব্যবঙ্গ আন্দোলনের গুরুত্ব || নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের গুরুত্ব ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি মহান ঘটনা। তাই আমরা আজ এখানে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করলাম। নব্যবঙ্গ আন্দোলনের কারণে ভারতে স্বাধীনতার মধ্যে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল এবং এটি ভারতে জাতীয় গর্বের একটি উদাহরণ।
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিবৃত করো। (Narrate the Brief History of Young Bengal Movement.)
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ একদল যুবক ঊনবিংশ শতকে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের উগ্র - পরিবর্তনকামী মনোভাব গড়ে তুলেছিল।
পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শনের সংস্পর্শে এসে এই যুবসম্প্রদায় ভারতবর্ষের বিশেষত হিন্দুধর্মের প্রচলিত সমস্ত রীতিনীতিকে অসার ও অবাস্তব বলে মনে করতে শুরু করে। রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যখন একদল শিক্ষিত মানুষ এদেশের ঐতিহ্যকে স্মরণে রেখে সংস্কারের মাধ্যমে তার গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তখন একদল শিক্ষিত যুবক এদেশের ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
এই যুবকদল প্রচলিত সকল প্রকার ধর্মীয় রীতিনীতি ও সামাজিক আচার - অনুষ্ঠানকে নস্যাৎ করে দিয়ে তাকে নতুন করে গড়ে তোলার তত্ত্ব প্রচার করেন। নৈরাজ্যবাদীদের মতো নব্যবঙ্গ দল দেশের সবকিছুকেই সমালোচনা করতে শুরু করেন। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল এঁদের আক্রমণের লক্ষ্য।
ভারতের সবকিছুকেই এঁরা তীব্র ভাষায় নিন্দা করতে শুরু করেন। এঁদের বিশ্বাস ছিল যে, পুরাতন যা অসার, যা অবাস্তব তাকে সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত না করলে নতুনের বা বাস্তবের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। এই কারণে অনেকে এঁদের ‘চরমপন্থী’ বলে অভিহিত করেন।
ডিরোজিওঃ
‘নব্যবঙ্গ’ নামে খ্যাত যুবাদলের প্রাণপুরুষ ছিলেন হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রিঃ) নামক জনৈক প্রতিভাবান অ্যাংলো - ইন্ডিয়ান শিক্ষক। মাত্র সতেরো বৎসর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনাকার্যে নিযুক্ত ছিলেন।
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সফল। তাঁর প্রেরণার উৎস ছিল ফরাসি বিপ্লব। জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডিরোজিও আধুনিকতম ও প্রগতিশীল ধ্যানধারণার পরিপোষণ শুরু করেন। টমাস, পেইন, হিউম প্রমুখের যুক্তিবাদী দর্শন তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কবি, সুলেখক, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নিজে বয়সে তরুণ হলেও তিনি একদল তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রের বিশেষ অনুরাগ ও আনুগত্যের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। মাত্র তেইশ বৎসর বয়সে এই প্রতিভাবান তরুণের মৃত্যু হয়।
যুক্তিবাদঃ
স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদে বিশ্বাসী ডিরোজিও তাঁর অনুগামী ছাত্রদের কোনো কিছুই বিনাবিচারে গ্রহণ বা স্বীকার করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন, “স্বাধীন চিন্তার দ্বারা মত ও পথ স্থির করিবে, কোন প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুসরণ করিবে না, জীবনে ও মরণে একমাত্র সত্যকেই অবলম্বন করিবে, সকল প্রকার সৎগুণ অনুশীলন করিবে, এবং যাহা কিছু অন্যায় ও অসৎ তাহা পরিহার করিবে।”
আরও পড়ুন- সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
তাঁরা অনুগামীরা যাতে নীচতা ও নৈতিক স্খলনদোষে পতিত না হয়, এ বিষয়ে তিনি সর্বদা তাদের সতর্ক করে দিতেন। ডিরোজিওর শিষ্যগণ পচনশীল প্রাচীন প্রথাসমূহ, রীতিনীতি ও সংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। নারীজাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোও নব্যবঙ্গ দলের অন্যতম কর্মসূচি ছিল।
অধ্যাপক বিপিনচন্দ্র ডিরোজিওকে ‘আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয়বাদী কবি’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, ডিরোজিও এবং নব্যবঙ্গ নামে পরিচিত তাঁর অনুগামীরা গভীর স্বদেশপ্রেমে আপ্লুত ছিলেন।
সীমাবদ্ধতাঃ
ডিরোজিও তাঁর অনুগামী ছাত্রদের নিয়ে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ (Academic Association) নামে একটি সমিতি গঠন করেছিলেন (১৮২৮ খ্রিঃ)। এই সমিতিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হত।
তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাধানাথ সিকদার, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ। উগ্র সংস্কারকামী প্রবণতায় এঁদের ব্যবহার ও কথাবার্তায় উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনার প্রাধান্য দেখা যায়। এঁদের বাণী ছিল “হিন্দুধর্ম নিপাত যাক, কুসংস্কার নিপাত যাক।” ব্রাহ্মণদের উত্তেজিত করার জন্য এঁরা চিৎকার করে ঘোষণা করতেন, “আমরা গোরু খাই গো, আমরা গোরু খাই।” কেউ কেউ প্রকাশ্যে পৈতা ছিঁড়ে পদদলিত করতেন।
মাধবচন্দ্র মল্লিক কলেজ পত্রিকায় লেখেন: “If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism ।” রসিকৃষ্ণ মল্লিক ঘোষণা করেন, “গঙ্গার পবিত্রতায় তাঁদের বিশ্বাস নেই” ইত্যাদি। এই অতি- উচ্ছ্বাস হিন্দুদের মনে যুগপৎ ক্ষোভ ও আতঙ্কের সঞ্চার করে। কলকাতার প্রভাবশালী হিন্দু - নেতাদের চাপে ডিরোজিও হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর অল্পকাল মধ্যেই তাঁর অকালপ্রয়াণ ঘটে।
অবদানঃ
আপাতদৃষ্টিতে ‘নব্যবঙ্গ’ যুবকদের নৈরাশ্যবাদী ও ভাঙনধর্মী মনে হলেও, এটিই তাঁদের সম্পর্কে শেষ কথা হতে পারে না। ডিরোজিও ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী রোমান্টিক সংস্কারক। হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি, অমানবিক আচার - অনুষ্ঠান, অযৌক্তিক অবাস্তব চিন্তাভাবনা তাঁর হৃদয়কে ব্যথিত করেছিল। তাঁর আহ্বানে শিক্ষিত যুবকদল হয়তো কিছুটা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ভারতের সমাজব্যবস্থা তাঁদের কাছে কম ঋণী নয়।
এই উগ্র ছাত্রমণ্ডলীর অধিকাংশই ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। কর্মজীবনে এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই সংস্কারক ও সমাজসেবীতে পরিণত হয়েছিলেন। প্রচলিত বিধিব্যবস্থার ধ্বংস কামনার পাশাপাশি এঁরা গঠনমূলক কাজও করে গিয়েছিলেন। জাতিগঠনের বিভিন্ন কাজে এঁরা আত্মনিয়োগ করেন।
আরও পড়ুন- সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগরের অবদান
কালক্রমে এঁরা পরিণতবুদ্ধি জাতীয়তাবাদীতে পরিণত হন। এঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলির মধ্যে ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এন্কোয়ারার’ (Enquirer), ‘বেঙ্গল স্পেটেটর’, ‘হিন্দু পাইওনীয়র’ প্রভৃতি দেশবাসীর মনে যুক্তিবাদ বিস্তার এবং কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার উদ্দেশ্যে এঁরা ‘জ্ঞান - আহরণী সমিতি’ (Society for the Aquisition of General Knowledge) প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৩৮ খ্রিঃ)। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অর্জন, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারীশিক্ষা প্রসার, পাঠাগার স্থাপন প্রভৃতি বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সঙ্গে এঁরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এককথায়, বাংলা তথা ভারতের ভাবজগতের পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে নব্যবঙ্গ সদস্যদের অবদান উল্লেখযোগ্য।
ব্যর্থতার কারণঃ
কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ত্রুটি নব্যবঙ্গ আন্দোলনকে দুর্বল করে তুলেছিল।
প্রথমত, নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ধারক এবং বাহক ছিলেন শহুরে অভিজাতগণ। দেশের সাধারণ মানুষের সাথে এঁদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এঁদের বক্তব্য প্রচারিত হত কেবল ছাপানো পুস্তিকার মাধ্যমে। ফলে এর প্রসার ছিল কেবল শহুরে এবং শিক্ষিতশ্রেণির মধ্যে।
দ্বিতীয়ত, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকশ্রেণির উন্নতির প্রতি এঁদের কোনো আগ্রহ ছিল না। অথচ জনসংখ্যার মূল অংশ ছিল এরাই। কৃষি-উন্নয়নমূলক চিন্তাভাবনা বর্জিত হবার ফলে কৃষককুল এই আন্দোলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিষ্পৃহ হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত না করে, তাকে আক্রমণ করার ফলে পুরো সম্প্রদায়ই নব্যবঙ্গদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। চতুর্থত, এঁদের প্রগতিশীল ধ্যানধারণা গ্রহণ করার মতো সামাজিক পরিবেশ তখনো গড়ে ওঠেনি। তাই সৎ এবং প্রয়োজনীয় হলেও এঁদের বক্তব্য ব্যাপক জনসমর্থনলাভে বঞ্চিত হয়েছিল।
উপরোক্ত ত্রুটি সত্ত্বেও ভারতীয় চেতনার উন্মেষ নব্যবঙ্গ আন্দোলনের অবদান স্মরণীয়। এঁদের আন্দোলন এবং কঠোর সমালোচনা রক্ষণশীল হিন্দুসমাজকে যথেষ্ট নাড়া দেয় এবং সংস্কারের আবশ্যিকতা বুঝিয়ে দেয়। তাই জাতীয় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “এঁরাই বাংলায় আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক। এঁরাই আমাদের জাতির পিতা, এঁদের গুণাবলী চিরস্মরণীয়। এঁদের দুর্বলতা বা দোষ - ত্রুটি সম্বন্ধে মুখর হয়ে ওঠা উচিত হবে না।” [ They (Derozians) are “the pioneers of modern civilisation of Bengal, the conscript fathers of our race whose virtues will excite veneration and whose failings will be treated with gentlest consideration.” ]।