সংস্কার ও পাশ্চাত্যীকরণ ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের এই পোস্ট এ সম্পুর্ণ আলোচনা করা হল। ভারতে সংস্কার ও পাশ্চাত্যীকরণ ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন যার উত্তর সকল ছাত্রছাত্রীদের জানা প্রয়োজন। তাই আর দেড়ি না করে নিচে দেওয়া সংস্কার ও পাশ্চাত্যীকরণ মনযোগ সহকারে পড়ুন।
সংস্কার ও পাশ্চাত্যীকরণ ভূমিকা
কবিগুরু লিখেছেন,’বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে পোহালে শর্বরী।’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করতে এসে দখল করেছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা। ফলে এদেশের শুভাশুভের দায়িত্ব বর্তেছিল কোম্পানির উপর। কেবল সাম্রাজ্য বিজয় নয়, শাসকের অন্যতম কর্তব্য হল শাসিতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং ন্যায়বিচারের সুযোগ সৃষ্টি করা।
একচ্ছত্র ক্ষমতা’ একচ্ছত্র দুর্নীতির জন্ম দেয়’ -এই আপ্তবাক্য কোম্পানির ক্ষেত্রেও সত্য হয়েছিল। ভারতের বিপুল সম্পদ, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের মধ্যে জন্ম দিয়েছিল সীমাহীন দুর্নীতির। অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করা কোম্পানির কর্মচারীদের আবশ্যিক কর্তব্যে পরিণত হয়েছিল। এমনকি কোম্পানির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেও তার কর্মচারীগণ ব্যক্তিগত মুনাফা বৃদ্ধিতে উৎসাহী হয়ে পড়েছিল।
একদিকে শাসিত জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকের বিকাশ ঘটানো, শিক্ষাবিস্তার করা, ন্যায়বিচার প্রবর্তন করা ও তাকে সহজলভ্য করে তোলা এবং অন্যদিকে শাসকের নিজের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা, দুর্নীতি দূর করে কোম্পানির কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা, কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করা প্রভৃতির জন্য ভারতে আগত গভর্নর জেনারেলগণ বিভিন্ন সংস্কারকার্য সম্পন্ন করেছিলেন।
এইসব সংস্কার কাজের দুটি দিক ছিল। একদিকে এইসব সংস্কারের মাধ্যমে যেমন ভারতবাসীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব হয়েছিল, বৃদ্ধি পেয়েছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ; তেমনি সংস্কারকগণ সংস্কার আইনসমূহ পাশ করে ভারতবর্ষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সংস্কারের পশ্চাতে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির হাতকে সুদৃঢ় করা। অবশ্য সতীদাহ নিবারণ বা পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তার সংক্রান্ত আইনগুলি জারি করে তাঁরা ভারতবাসীর প্রভূত মঙ্গল সাধন করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ভারতবাসীর জনজীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পদধ্বনি শ্রুত হতে থাকে। অশিক্ষা এবং অল্প শিক্ষার ফলে ভারতীয় সমাজ ছিল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। ধর্মভাবনা ছিল আচার-সর্বস্ব এবং ভ্রান্ত ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু ভারতীয় সমাজ ধর্মকেন্দ্রিক, যেহেতু ভারতবাসীর জীবনযাত্রা ধর্ম-বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেহেতু ধর্ম-ভাবনা ভ্রান্ত তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে সমাজজীবন ছিল কুসংস্কারে ভরপুর। তখন এদেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল টোল, মক্তব ও পাঠশালার ছোটো গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ। পাঠ্যপুস্তক ছিল না বললেই চলে। নারীশিক্ষা ছিল সম্পূর্ণভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রিত।
আরও পড়ুন- সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগরের অবদান
পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীজাতি ছিল সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত। জাতীয়চেতনা বলে কোনো বস্তু ছিল না। সতীদাহ, সন্তান বিসর্জন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, নরবলি প্রভৃতি অবাস্তব, নৃশংস ও অযৌক্তিক আচার-অনুষ্ঠানের ফলে সমাজজীবন ছিল অসহনীয়, কিন্তু চেতনার অভাবহেতু এই অসহায়ত্ব ছিল মূক।
পলাশী ও বক্সারের প্রান্তরে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আভাস মিলেছিল, তাতে ভারতবাসী খুব বেশি বিচলিত ছিল না। কারণ শাসক পরিবর্তন তখন জনসাধারণের কাছে কোনো বিশিষ্ট ঘটনা বলে চিহ্নিত হত না।
কালক্রমে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন ঘটে। প্রথমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং পরে সরকারি বদান্যতায় ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের পঠনপাঠন শুরু হয়। ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে নতুন বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, স্বামী বিবেকানন্দ, ডিরোজিও, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ শিক্ষিত ও উদারপন্থী ভারতবাসীর নেতৃত্বে শিক্ষিত সম্প্রদায় শুরু করে ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলন। ঊনবিংশ শতকে এই সংস্কার আন্দোলন সাফল্যের সাথে পরিচালিত হয়।
উদারপন্থীদের এই আন্দোলনে কিছু কিছু সনাতনপন্থী বাধা সৃষ্টি করলেও’হিতবাদী’ আদর্শে উদ্বুদ্ধ লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক, মেকলে প্রমুখের চেষ্টায় সতীদাহ নিরোধ আইন পাশ হয়। আইনানুগ করা হয় বিধবাবিবাহকে।
ঊনবিংশ শতকে ভারত-ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল জাতীয় চেতনার জাগরণ। এতকাল যে আঞ্চলিকতাবোধ ভারতবাসীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে তা দূর হতে শুরু করে। আঞ্চলিকতাবোধের পরিবর্তে বিকশিত হয় ভারতবোধ। জাতীয় চেতনার বিকাশ ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে ইংরেজের কুশাসনের বিরুদ্ধে।
দেশ জুড়ে প্রকাশিত হয় সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। অবশ্য ইংরেজদের দ্বারা পরিচালিত কিছু সংবাদপত্র যেমন ইংলিশম্যান প্রভৃতি ব্রিটিশ সরকারের শোষণকেই সমর্থন করে চলে। কিন্তু ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত দেশীয় ভাষা এবং ইংরেজি ভাষার পত্রপত্রিকাগুলি প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করতে থাকে। সরকারও তার স্বৈরাচারী শাসন কায়েম রাখার জন্য একাধিক নিয়ন্ত্রণমূলক আইন জারি করতে থাকে। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ওঠে ভারতবাসীর মধ্য থেকে। সরকারও ঐসব নিয়ন্ত্রণ মাঝে মাঝে শিথিল করতে বাধ্য হয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলন এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে ভারতবাসীর যে জাতীয়তাবোধ জাগরিত হয়, তাই কালক্রমে জন্ম দেয় জাতীয় কংগ্রেসের। এই গণ-সংগঠনের নেতৃত্বে ভারতব্যাপী শুরু হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।