ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সংস্কারগুলি আলোচনা করো। (Discuss the administrative and revenue reforms of Warren Hestings.)
ওয়ারেন হেস্টিংস এর শাসন ও রাজস্ব সংস্কার সম্পর্কে আমাদের এই পোস্ট এ সম্পুর্ণ আলোচনা করা হল। ওয়ারেন হেস্টিংস এর শাসন ও রাজস্ব সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন যার উত্তর সকল ছাত্রছাত্রীদের জানা প্রয়োজন। তাই আর দেড়ি না করে নিচে দেওয়া ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সংস্কারগুলি আলোচনা করো? মনযোগ সহকারে পড়ুন।
সুশাসক:
প্রশাসক হিসেবে ওয়ারেন হেস্টিংসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্লাইভ বাংলাদেশ তথা ভারতে কোম্পানির রাজত্বের যে সূচনা করেছিলেন, দক্ষ-প্রশাসন দ্বারা ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিলেন। ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে তুলনা করে বিখ্যাত ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন, “ক্লাইভ বিজিত রাজ্যে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রবর্তনে ব্যর্থ ছিলেন।
এ কাজে তাঁর উত্তরাধিকারী অনেক বেশি দৃঢ়তা ও বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।” স্যার আলফ্রেড লায়াল বলেছেন, “ শাসন-বিষয়ে হেস্টিংস মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।” ভিনসেন্ট স্মিথ মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে ওয়ারেন হেস্টিংসের তুলনা করে বলেছেন, “উভয়েরই সংগঠন প্রতিভা ছিল এবং উভয়েই মৌলিক নীতিকে কার্যকর করার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালাতে পারতেন।”
প্রশাসক হিসেবে দক্ষ হলেও, এ কথা সত্য যে, ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ও বৃদ্ধি করা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে কোম্পানির স্বার্থ রক্ষিত হবে না। বস্তুত দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত শাসন দ্বারা তিনি চেয়েছিলেন-
(১) কোম্পানির বাণিজ্যিক আয় ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে।
(২) কোম্পানির সামাজিক স্বার্থ পূরণ করা এবং
(৩) ভারতে আগত ইংরেজ জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা।
উপর্যুপরি পলাশী ও বক্সার-এর যুদ্ধে বিপর্যয়ের ফলে বাংলায় নবাবি প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। তদুপরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল বাদশার হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে’দেওয়ানি’ লাভ করে যে’দ্বৈত শাসন’ শুরু করে, তাতে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ঘোরালো হয়ে ওঠে। এই অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেয় কোম্পানির স্বার্থান্ধ কর্মচারীরা।
আরও পড়ুন- সংস্কার ও পাশ্চাত্যীকরণ ভূমিকা
তারা বাংলা ও কোম্পানির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের স্বার্থপূরণে মনোযোগী হয়ে ওঠে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। কোম্পানির কর্মচারীদের অসততার ফলে কোম্পানির আয়ও প্রচুর কমে যায়। এহেন অবস্থায় ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর-এর দায়িত্ব নিয়ে ভারতে আসেন (১৭৭২ খ্রিঃ)। পরের বছরের রেগুলেটিং আইন জারি করে তাঁকে’গভর্নর-জেনারেল’ আখ্যা দেওয়া হয়। এই নতুন সম্মানের মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন।
প্রশাসনিক সংস্কার:
দ্বৈত শাসনব্যবস্থার’ কুফল সম্বন্ধে তিনি পূর্বেই অবহিত হয়েছিলেন। তাই ভারতে এসেই হেস্টিংস এক আদেশবলে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান (১৭৭২ খ্রিঃ) এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানির হাতে নেন। দ্বৈত শাসনের দুই অত্যাচারী নায়ক রেজা খাঁ ও সীতাব রায়কে অভিযুক্ত করে পদচ্যুত করা হয় এবং নায়েব ও সুবা পদ দুটি বিলুপ্ত করা হয়। তিনি নবাবের বাৎসরিক ভাতা ৩২ লক্ষ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ লক্ষ টাকা করেন। সরকারি কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। কোম্পানির সদরদপ্তর হয় কলকাতা। ফলে এখন থেকেই কলকাতার রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
রাজস্ব সংস্কার:
রাজস্ব ব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত ও নিয়মিত করার জন্য হেস্টিংস বেশ কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ কিছু কালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া, যাতে জমিদার ও কোম্পানি উভয়েই স্ব স্ব প্রাপ্য ও দেয় রাজস্ব সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারে। এজন্য তিনি কয়েকটি ব্যবস্থা নেন। স্থির হয়, পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন- ইতিহাস মক টেস্ট কমপিটিটিভ এক্সাম এর জন্য
জেলায় হাজির হয়ে জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করার জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি (Committee of Circuit) গঠন করা হয়। ইতিপূর্বে কোম্পানির রাজস্ব বিষয়ে তত্ত্বাবধান করার জন্য’সুপারভাইজার’ নামক কর্মচারী ছিল। হেস্টিংস এদের নতুন নামকরণ করেন’সংগ্রাহক’ বা’কালেক্টর’ (Collector)। এইসব শ্বেতাঙ্গ কালেক্টরের হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার ন্যস্ত হয়।
দেওয়ানি বিষয়ে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব দেওয়া হয় বোর্ড অব রেভেনিউ (Board of Revenue) নামক একটি সভার উপর। কাউন্সিলের দুজন সদস্য এবং তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নিয়ে এই রাজস্ব-বোর্ড গঠন করা হয়। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটিকে একটি প্রাদেশিক কাউন্সিলের অধীনে রাখা হয়। প্রত্যেক কাউন্সিলকে সাহায্য করার জন্য একজন করে ভারতীয় দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। কাউন্সিলের সদস্যরা যাতে দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারেন, তার জন্য তাঁদের মাসিক তিন হাজার টাকা বেতন স্থির হয়।
একশালা বন্দোবস্ত:
কিন্তু পাঁচশালা বন্দোবক্ত স্থায়ী হয় না। হেস্টিংস ভেবেছিলেন, এই ব্যবস্থার ফলে প্রকৃত জমিদাররা উপকৃত হবে এবং রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত হবে। কিন্তু দেখা গেল প্রকৃত জমিদারের বদলে বহু ফড়ে-মহাজন জমি বন্দোবস্ত পেয়ে গেছে। কোম্পানির কর্মচারীরাও জমিদারি বৃত্তিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে। অত্যাচার বেড়েছে চাষিদের উপর। এমতাবস্থায় হেস্টিংস পূর্বসিদ্ধান্ত বাতিল করে পুনরায় এক বছরের জন্য বন্দোবস্ত (একশালা) প্রথা চালু করেন।
ভ্রাম্যমাণ কমিটিও ইতিমধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তিনি এই কমিটি উঠিয়ে দেন এবং প্রাদেশিক কাউন্সিলেরও বিলোপসাধন করে রাজস্ব-সংক্রান্ত সমস্ত কর্তৃত্ব রাজস্ব বোর্ডের হাতে অর্পণ করেন। দুর্নীতিগ্রস্ত হবার জন্য’কালেক্টর’-পদেরও অবসান ঘটানো হয়। অতঃপর (১৭৭৬ খ্রিঃ) রাজস্ব-সংক্রান্ত কাজ সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য হেস্টিংস’আমিনি-কমিশন’ (Amini-Commission) নিযুক্ত করেন।
বাণিজ্য সংস্কার:
কোম্পানির বাণিজ্যবৃদ্ধির জন্য হেস্টিংস’দত্তক’ প্রথা লোপ করেন (১৭৭৩ খ্রিঃ)। ফলে কোম্পানির কর্মচারী ও এজেন্টদের অবৈধ বাণিজ্য করার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। কেবলমাত্র লবণ, সুপারি ও তামাকের উপর কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার বজায় রেখে অন্যান্য দ্রব্যের বাণিজ্য সকলের নিকট উন্মুক্ত রাখা হয়। এজন্য ভারতীয় বা ইউরোপীয় সকলকেই শতকরা ২.৫ টাকা হারে শুল্ক দিতে বলা হয়। জমিদারদের নিজস্ব শুল্ক আদায়ের ঘাঁটিগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফলে সমগ্র প্রদেশে দ্রব্যচলাচল সহজ হয়ে ওঠে। তিনি কেবলমাত্র ৫ টি শুল্কঘাঁটি বজায় রাখেন। এগুলি হল মুর্শিদাবাদ, হুগলী, কলকাতা, পাটনা এবং ঢাকা। তাঁতিদের উপর যাতে অত্যাচার না হয়, সে বিষয়ে তিনি কঠোর নির্দেশ জারি করেন। বাণিজ্যের উন্নতির জন্য হেস্টিংস ভুটান ও তিব্বতে জর্জ বোগল-এর নেতৃত্বে বাণিজ্য-প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। মুদ্রা-সংস্কারের প্রতিও তিনি আগ্রহী হয়েছিলেন।
বিচার-সংস্কার:
বিচারবিভাগের দুর্নীতি দূর করে বিচারব্যবস্থাকে সুষ্ঠু, সুস্থ ও ন্যায়সংগত করার জন্য হেস্টিংস বিশেষ মনোযোগী হয়েছিলেন। তাঁর এদেশে আগমনকালে দ্বৈত-শাসনের ফলে বিচারব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল। নবাবের হাতে ছিল ফৌজদারি বিচার পরিচালনার দায়িত্ব। কারণ তৎকালীন রীতি অনুযায়ী রাজস্ব ও বিচারবিভাগ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো ক্ষমতা না থাকার ফলে নবাব যথাযথভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না। ফলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিচারব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছিল। হেস্টিংস বুঝেছিলেন যে, বিচারব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে না পারলে দেশে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। আর দুর্নীতি দূর না-হলে কোম্পানির বাণিজ্যিক তথা আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বার্থও সিদ্ধ হবে না। তাই তিনি মুঘল আমলের জটিল বিচারপদ্ধতি পরিহার করে ইউরোপীয় আধুনিক বিচারব্যবস্থা প্রণয়নে উদ্যোগী হন।
বিকেন্দ্রীকরণ:
বিচারব্যবস্থাকে জনমুখী ও সহজলভ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে হেস্টিংস সমগ্র বাংলাকে ৩৫ টি জেলায় বিভক্ত করেন। প্রতিটি জেলাই দেওয়ানি ও ফৌজদারি (নিজামতি) বিচারের সর্বনিম্ন ভিত্তি (unit) হিসেবে গৃহীত হয়।’ভ্রাম্যমাণ কমিটি’র সুপারিশ অনুসারে প্রতিটি জেলায় একটি করে মফঃস্বল দেওয়ানি আদালত ও মফঃস্বল ফৌজদারি আদালত স্থাপন করা হয়।
হিন্দু পণ্ডিতদের সহায়তায়’হিন্দু আইন বিধি’ সংকলন করা হয়। মফঃস্বল দেওয়ানি আদালতের বিচার পরিচালনা করতেন কালেক্টরগণ। বিচারে তাঁদের সাহায্য করতেন হিন্দু পণ্ডিত ও মৌলবিগণ। এঁদের পরামর্শে হিন্দু ও মুসলিম আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালিত হত। জেলা ফৌজদারি আদালতে কাজি ও মুফতিগণ বিচার পরিচালনা করতেন। উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণসহ ফৌজদারি বিচার পরিচালিত হচ্ছে কিনা, তা কালেক্টরগণ তত্ত্বাবধান করতেন। এর উপরে ছিল’সদর দেওয়ানি আদালত’ ও’সদর নিজামত আদালত।
এই বিচারালয় দুটি যথাক্রমে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে স্থাপিত হয়েছিল। মফঃস্বল দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যথাক্রমে সদর দেওয়ানি ও সদর নিজামত আদালতে আপিল করা যেত। জেলা ফৌজদারি আদালত সদর নিজামত আদালতের অনুমোদন ব্যতীত কারও প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে পারত না। সদর নিজামত আদালতে বিচারকার্য পরিচালিত করতেন নবাবের প্রতিনিধি ও প্রধান কাজি। গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিল এই আদালতের কাজকর্মের উপর নজর রাখতেন।
বিচার-বিষয়ক নিয়ম:
হেস্টিংস-এর শাসনকালে বিচারবিভাগে কয়েকটি নিয়ম চালু হয়। তাঁর নির্দেশে প্রত্যেক আদালতে মোকদ্দমা-সংক্রান্ত নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। নিয়ম করা হয় যে, ঘটনায় বারো বছরের মধ্যে মামলা রুজু না করলে তা তামাদি হয়ে যাবে। সুদের হার নিয়ন্ত্রিত রাখার প্রতিও সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়।
বিচারের ক্ষেত্রে হেস্টিংসের বড়ো অবদান হল যে, তিনি আইনের চক্ষে সকলের সম-অধিকারের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন এবং বিচারব্যবস্থাকে কাজির মর্জির উপর নির্ভরশীল না-রেখে তাকে কিছুটা ন্যায়ানুগ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।