সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা কেন হয়েছিল? এই আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক বিবরণ সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন্য খুবই হেল্পফুল হবে।
আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা কেন হয়েছিল? এই আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক বিবরণ দাও। ( Why was civil disobedience movement launched? Give a serial history of this movement.)
উত্তর-
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতের জাতীয় সংগ্রামের গণ-আন্দোলনের প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিক এই পর্বের সমাপ্তি ঘটে। বলা যেতে পারে, প্রায় ৮ মাস পরে আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসীর গণ-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের শুরু হয়।
অসহযোগ-পরবর্তী কংগ্রেস:
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং গান্ধীজির কারাদণ্ড ভারতবাসীর জাতীয় আন্দোলনকে স্তিমিত করে দিয়েছিল। এই অবস্থা বজায়, ছিল প্রায় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আলোচ্য সময়ে ‘পরিবর্তন-বিরোধী' (No-changers) কংগ্রেস সদস্যরা গান্ধীজির পরামর্শমতো গঠনমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু ‘পরিবর্তনপন্থী' (Pro-changers) সদস্যরা চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু প্রমুখের নেতৃত্বে সক্রিয় কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে স্বরাজ্য দল গঠন করে আইনসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং আইনসভার মধ্যে থেকে সরকারের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য ১৯২৩-এর নির্বাচনে স্বরাজ্য দল বিপুলভাবে জয়লাভ করলেও সরকারের সাথে তীব্র মতভেদের দরুন আইনসভা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সাইমন কমিশন:
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড আরউইন ভারতের শাসন- সংস্কার (১৯১৯ খ্রিঃ) পর্যালোচনার জন্য একটি বিধিবদ্ধ (Statulory) কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন। উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিশনে দুজন শ্রমিকদলের ও চারজন রক্ষণশীল দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু কোনো ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ-সহ প্রায় প্রত্যেকটি ভারতীয় রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। কংগ্রেস এই কমিশন বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সাইমন কমিশন ভারতের মাটিতে পদার্পণ করলে দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। সাইমন কমিশন বোম্বাই শহরে পদার্পণ করলে (১৯২৮ খ্রিঃ) সারা দেশে পালিত হয় হরতাল, প্রদর্শিত হয় কালো পতাকা। সাইমন ফিরে যাও' (Go back Simon) ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে দেশের আকাশ-বাতাস।
কংগ্রেস কর্তৃক পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা:
ইতিমধ্যে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে (১৯২৭ খ্রিঃ) 'পূর্ণ স্বাধীনতা' জাতীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী অধিবেশনে (কলিকাতা, ১৯২৮) গান্ধীজির ইচ্ছানুযায়ী সরকারকে এক বছর সময় দেওয়া হয়। এক প্রস্তাবে বলা হয়, “এক বছরের মধ্যে ভারতকে ‘ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস্' দেওয়া না হলে কংগ্রেস ‘পূর্ণ স্বাধীনতা' অর্জনকে লক্ষ্য রূপে গ্রহণ করবে।” কিন্তু এক বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার নীরব থাকে। ফলে ১৯২৯-এর লাহোর অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। এই অধিবেশনে যুব প্রতিনিধি জওহরলাল নেহরু সভাপতি নির্বাচিত হলে কংগ্রেসের সংগ্রামি কর্মসূচি গ্রহণের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
গান্ধী-আরউইন বৈঠক:
ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনের উদ্দেশ্যে এই সময় ব্রিটিশ সরকার একটি 'গোল টেবিল বৈঠক আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে (অক্টোবর, ১৯২৯ খ্রিঃ)। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস স্বাভাবিক কারণেই এই বৈঠকের উদ্দেশ্য এ সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে। কংগ্রেস ও সরকারের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি অবসানের জন্য গান্ধীজি ও বড়োলাট আরউইনের মধ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সরকার ভারতকে 'ডোমিনিয়াম স্ট্যাটাস' প্রদানের ব্যাপারে কোনো পূর্ব-প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকার করলে এই বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়।
আইন অমান্য শুরু:
১৯২৯-এর ৩১ শে ডিসেম্বর মধ্যরাত্রে কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরু ভারতবর্ষের ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৩০- এর ২৬শে জানুয়ারি দিনটি সারাদেশে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে 'স্বাধীনতা দিবস' রূপে পালিত হয়। ১৯৩০-এর ফেব্রুয়ারিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি আইন- অমান্য আন্দোলন পরিচালনার সর্বময় কর্তৃত্ব গান্ধীজি'র হাতে অর্পণ করে। ঐ মাসেই গান্ধীজি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া' পত্রিকায় আইন-অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। গভীর একাগ্রতা ও ত্যাগের প্রতিজ্ঞা নিয়ে সারাদেশ অপেক্ষা করতে থাকে গান্ধীজির শেষ নির্দেশের জন্য। ২রা মার্চ গান্ধীজি বড়োলাট আরউইনকে এক পত্রে জানান যে, লবণ, আইন ভঙ্গ করতে বাধ্য হবেন। আরউইন গান্ধীজির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। অতপর গান্ধীজি গুজরাটের ডাণ্ডিতে লবণ আইন ভঙ্গ করার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন।
ডাণ্ডি অভিযান:
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সবরমতী আশ্রমের ৭৮ জন অনুগামীসহ গান্ধীজি ডাণ্ডি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রাপথে তিনি জনগণকে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। দীর্ঘ দুশো মাইল অতিক্রম করে ৬ই এপ্রিল তিনি লবণ আইন অমান্য করেন। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে শুরু হয় আইন অমান্য। যেখানে সমুদ্র নেই সেখানে জনগণ অন্যান্য সরকারি আইন ভঙ্গ করতে শুরু করেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে বিদেশি বস্ত্র বর্জন, মাদক দ্রব্য ও ঔষধ বর্জন ইত্যাদি। অসংখ্য মহিলা এই আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করেন। রক্ষণশীলতা ও পর্দা-প্রথার সংস্কার কাটিয়ে মহিলাদের এই উৎসাহ ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
আব্দুল গফর খান:
খান আব্দুল গফর খান-এর নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আইন-অমান্য আন্দোলন ব্যাপক আকার লাভ করে। তাঁর অনুগামীরা 'খোদা- ই খিদমতগার' (ঈশ্বরের সেবক) নামে অভিহিত হত। লাল রংয়ের পোশাক পরত বলে এরা 'লালকোর্তা' নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এই দলটি সরকারিভাবে কংগ্রেসের অংশ রূপে স্বীকৃতি লাভ করে। মেদিনীপুরে চাষীরা খাজনা বন্ধ করে দেয়। মধ্যপ্রদেশে জনগণ সরকারি গাছ কেটে ফেলতে থাকে। বোম্বাইয়ের শোলাপুরে বস্ত্রশিল্প শ্রমিকেরা শহর অবরোধ করে রাখে।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক:
আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা সরকারকে চিহ্নিত করে তোলে। সরকার বুঝতে পারে যে, কেবলমাত্র দমনপীড়ন দ্বারা এই আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই প্রথম গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার উপলব্ধি করে যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারতীয় কোনো প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব নয়। তাই দ্বিতীয় বৈঠকে কংগ্রেসকে যোগদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। গান্ধীজি-সহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশমতো গান্ধীজি বড়োলাট আরউইন-এর সাথে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৩১-এর মার্চ মাসে ‘গান্ধী-আরউইন চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রেখে কংগ্রেসকে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের অনুরোধ করা হয়। বস্তুত এই চুক্তিতে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে এই চুক্তি অনুমোদিত হয়। কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে একমাত্র গান্ধীজি দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। কিন্তু মুসলিম লিগ প্রমুখের সাম্প্রদায়িক একগুঁয়েমির জন্য এই বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়।
Communal Award:
গোলটেবিল বৈঠক থেকে ভারতে ফিরে গান্ধীজি লক্ষ্য করেন যে, ব্রিটিশ সরকার একইভাবে দমনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি পুনরায় আন্দোলন শুরুর কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। বেআইনি ঘোষিত হয় কংগ্রেস ও তার গণসংগঠনসমূহ। বাজেয়াপ্ত করা হয় কংগ্রেসের সম্পত্তি। বন্ধ করা হয় কংগ্রেসের সব পত্রপত্রিকা।
ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার ঘোষণা করে 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা'র (Communal AWard) সিদ্ধান্ত (১৯৩২ খ্রিঃ)। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে 'পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর' ব্যবস্থা করা হয়। হরিজনদের জন্যও নির্বাচকমণ্ডলী নীতি গৃহীত হয়। এই সংবাদে মর্মাহত হয়ে গান্ধীজি অনশন শুরু করেন। অবশেষে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা ড. আম্বেদকরের সাথে তিনি ‘পুনা চুক্তি' স্বাক্ষরিত করেন ১৯৩২-এ। এর দ্বারা অনুন্নতশ্রেণির নির্বাচন- ব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হয়।
পুনা-চুক্তির পর গান্ধীজি আইন-অমান্য আন্দোলনের থেকে হরিজন-সমস্যার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েন। এদিকে নানা কারণে আইন অমান্য আন্দোলনের তীব্রতাও প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে আসে। ১৯৩৩-এর জুলাই মাসে কংগ্রেস গণ-আইন-অমান্যের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সরকারি বিরোধিতার ফলে এই আন্দোলন শুরুতেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৩৪-এর মে মাসে সারা ভারত কংগ্রেস কমিটি বিনাশর্তে আইন-অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।
মূল্যায়ন:
আইন অমান্য আন্দোলন আকস্মিক প্রত্যাহৃত হওয়ার সুভাষচন্দ্র, বিঠলভাই প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। বস্তুত কংগ্রেসের শপথবাণী আংশিক মাত্র পূর্ণ হবার আগেই আন্দোলনের অবসান প্রত্যাশিত ছিল না।
ড. মজুমদারের ভাষায় : .....আইন অমান্য আন্দোলন অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে (ignoble) শেষ হয়েছিল।” তবুও এই আন্দোলন সম্পূর্ণ ফলহীন ছিল - একথা বলা যায় না। রজনী পাম দত্তের মতে, “চার বছর ব্যাপী এই আন্দোলন ভারতবাসীকে যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার শিক্ষা দিয়েছেন, তার মূল্য অপরিসীম। এই চার বছরের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নি, পরন্তু তা আরও আত্মবিশ্বাস, গর্ব ও সংকল্পবদ্ধ হয়ে প্রকাশলাভ করে পরের আন্দোলনগুলিতে।”
অধ্যাপক সুমিত সরকার তাঁর গবেষণা গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, “তুলনামূলক ভাবে আইন-অমান্য আন্দোলনে গ্রামীণ কারিগর ও কৃষিজীবীরা অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। এ তত্ত্ব সঠিক হয়, তাহলে স্বীকার করতে হয় যে, আইন-অমান্য আন্দোলন ভারতবাসীর ভবিষ্যৎ গণ-আন্দোলনের ভিত্তিকে মসৃণ ও সুদৃঢ় করেছিল।”