Ads Area


আইন অমান্য অসহযোগের তুলনা কী ছিল

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে আইন অমান্য অসহযোগের তুলনা কী ছিল সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

আইন অমান্য অসহযোগের তুলনা কী ছিল

আইন অমান্য অসহযোগের তুলনা


তুমি কি মনে করো, আইন অমান্য আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের থেকে অগ্রণী বলা অতি সরলীকরণ হবে? (Do you think that consideration of Civil Disobedience as a forward step of Non-co-operation movement is a unjustified?)

উত্তর-

অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সাম্প্রতিক কোনো কোনো সমালোচক আইন- অমান্য আন্দোলনকে সব দিক থেকে অসহযোগ আন্দোলনের থেকে অগ্রণী পদক্ষেপ বলে মতপ্রকাশ করেছেন। বিষয়টি বিতর্কিত। দুটি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও গতি- প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, প্রায় ভিন্ন পরিস্থিতিতে আন্দোলন দুটি উদ্ভব ঘটেছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদী প্রেরণা ও গণ-অংশগ্রহণের প্রকৃতির বিচারে দুটি আন্দোলনই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই সাধারণভাবে আইন অমান্য আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় অগ্রণী পদক্ষেপ না-বলে দ্বিতীয়টিকে প্রথম আন্দোলনের পরবর্তী ক্রমোচ্চ স্তর বলা বেশি যুক্তিযুক্ত।

অসহযোগ আন্দোলনকে প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের মর্যাদা দেওয়া যায়। ইতিপূর্বে সংগঠিত আন্দোলনগুলির সাথে অসহযোগ আন্দোলনের মূলগত প্রভেদ হল এই যে, সমাজে সর্বস্তরের মানুষকে অসহযোগের আবেদন স্পর্শ করেছিল। অঞ্চলভেদে আন্দোলনের ব্যাপ্তি, তীব্রতা ও অভাব হয়তো স্বতন্ত্র ছিল। বহুক্ষেত্রে আঞ্চলিক সমস্যা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। কিন্তু আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী চরিত্র তাতে ক্ষুণ্ণ হয়নি।

গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আদর্শের প্রথম সার্থক প্রয়োগ হিসেবে অসহযোগ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া ছাত্রসমাজ, নারী জাতি এমনকি উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষও নানাভাবে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে ভারতের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন সর্বস্তরে ও সমস্ত অঞ্চলের মানুষকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। হিন্দু- মুসলমান ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হিসেবেও অসহযোগ আন্দোলন গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

অভূতপূর্ব সাড়া জাগালেও অসহযোগ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার মূল কারণ হল অসহযোগ ও সত্যাগ্রহের আদর্শ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণার অস্পষ্টতা। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের শ্রেণিগত বা বৃত্তিগত চাহিদার সাথে গান্ধীজির অহিংসা নীতির অনিবার্য দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত মাঝপথেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ভারতবাসীর অপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ব্রিটিশ সরকারের অনমনীয়তা

১৯২০-২২-এর অসমাপ্ত আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় হিসেবে ১৯৩০-৩৪-এর আইন- অমান্য আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের মতো আইন অমান্য আন্দোলনও ছিল সর্বভারতীয় আন্দোলন। কিন্তু লক্ষ্য ও ব্যাপ্তি উভয়দিক থেকেই আইন অমান্য আন্দোলন ছিল অনেক অগ্রণী ও পরিণত। অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সরকারকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সরকারকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেওয়া।

এই আন্দোলন ছিল সক্রিয়ভাবে বিপ্লবধর্মী। পূর্ণ স্বরাজ ছিল এর বিঘোষিত নীতি। ১৯২০-এর দশকের পরিস্থিতি এবং ১৯৩০-এর দশকের পরিস্থিতি এক ছিল না। অন্তবর্তী এক দশকে ভারতবাসীর রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ব্রিটিশবিরোধী লক্ষ্য অনেক বেশি পরিণত রূপ পেয়েছিল।

ব্রিটিশ অনমনীয়তার প্রতিবাদ স্বরূপ গান্ধীজি প্রতিটি মানুষের অতি প্রয়োজনীয় একটি দ্রব্য লবণ-সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রেখে বিদেশি শাসনের প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে লবণ আইন ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ছিল খুবই উপযোগী। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

যুক্তপ্রদেশ, গুজরাট ও বাংলাদেশের কৃষকরা স্বতস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। আইন অমান্য আন্দোলনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মহিলাদের অংশগ্রহণ। যুক্ত প্রদেশ পুলিশের জনৈক উচ্চ পদস্থ কর্তা জেনারেল উড মন্তব্য করেছিলেন- "Civil Disobedience marked a major step towards emancipation of Indian woman. " মহিলাদের সক্রিয় আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে যুব সম্প্রদায়ের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়।

আন্দোলনের পদ্ধতিগত দিক থেকেও অসহযোগের মঞ্চে আইন অমান্যের একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। উভয় আন্দোলনই অহিংস পথে পরিচালিত হলেও অসহযোগের মতো আইন অমান্য আন্দোলন যে সহজে প্রত্যাহৃত হবে না- একথা ১৯৩০ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি "Young India' পত্রিকায় গান্ধীজি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, চৌরিচৌরার মতো ছোটোখাটো সংঘর্ষ সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত নয়। অর্থাৎ আইন অমান্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা দৃঢ় প্রত্যয় গান্ধীজি আগেই ঘোষণা করেছিলেন।

অধ্যাপক সুমিত সরকার 'Modern India' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, আইন-অমান্য আন্দোলন সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণির ভারতবাসীর মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। জাতীয়তাবাদী, সাম্যবাদী, কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী সকলেই জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোতের সাথে যুক্ত হয়েছিল। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, পূর্ব ভারত, দক্ষিণ ভারত, যুক্তপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি ভারতের অধিকাংশ রাজ্য আইন অমান্য আন্দোলনের আহ্বানে উদবেলিত হয়েছিল। এমনকি কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের যেখানে অসহযোগ আন্দোলনের প্রায় কোনো প্রভাব পড়েনি, আইন-অমান্য আন্দোলনের সময় সেই স্থানগুলিও বিরাটভাবে আন্দোলিত হয়েছিল। ভারতের জাতীয় সংগ্রামকে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত করে তোলা এবং বিদ্রোহী মনোভাবকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রভাব ছিল অসীম।

গতিপ্রকৃতির বিচারে আইন-অমান্য আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় সবদিক থেকেই অগ্রণী বলা ঐতিহাসিক দিক থেকে যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ দুটি আন্দোলনের প্রস্তুতি ও পরিস্থিতি ছিল স্বতন্ত্র। আইন অমান্য আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে অগ্রণী ছিল- একথা যেমন সত্য, তেমনি এটিও অস্বীকার করা যায় না যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের থেকে পিছিয়ে ছিল।

এই সীমাবদ্ধতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হল মুসলমান সম্প্রদায়ের উদাসীনতা। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায় আইন-অমান্য আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে সচেষ্ট ছিল। ফলে আন্দোলনের জাতীয় চরিত্র অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল। কেবল হিন্দু-মুসলমান বিভেদ নয়। আইন- অমান্য আন্দোলনের সময় হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ বিরূপতাও ছিল লক্ষণীয়। বর্ণ হিন্দু ও হরিজনদের মধ্যে সামাজিক ভেদচিন্তা এতটাই প্রকট হয়েছিল যে, গান্ধীজিকে অনশন পর্যন্ত করতে হয়েছিল।

অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্রমিকরা যে ব্যাপক হারে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল, আইন-অমান্য আন্দোলনের সময় তা দেখা যায়নি।

ড. সুমিত সরকার আইন-অমান্য আন্দোলনে গণ-সমাবেশের আঞ্চলিক তারতম্য ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, এই আন্দোলন শহরাঞ্চলের শিক্ষিত সম্প্রদায় ও কলকারখানার শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ততটা সম্প্রসারিত হয়নি। এমনকি অসহযোগ আন্দোলনে মধ্যবিত্ত- শ্রেণি যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে যোগ দিয়েছিল, আইন-অমান্য আন্দোলনের সময় তার অভাব ছিল স্পষ্ট।

এই বিচারে আইন-অমান্য আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় সার্বিকভাবে অগ্রণী ও উন্নত বলা অতি সরলীকরণ। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতি ও শিক্ষা ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনাকে অনেকটা স্ফুরিত করেছিল, যার ফলে আইন অমান্য আন্দোলনের গভীরতা ছিল বেশি। তাই আইন-অমান্য আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের থেকে উন্নত না বলে 'অগ্রণী পর্যায়' বলাই যুক্তিযুক্ত।

আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area