Ads Area


সাইমন কমিশন গঠন থেকে লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশন পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচি

লাহোর কংগ্রেসের পটভূমি

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে সাইমন কমিশন গঠন থেকে লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশন পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচি সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

সাইমন কমিশন গঠন থেকে লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশন পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচি

সাইমন কমিশন গঠন থেকে লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশন পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচি উল্লেখ করো। [ Describe the programme of the National Congress between the Simon Commission and the Lahore Congress (1929).


উত্তর-

ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা শিথিল করার উদ্দেশ্যে ‘সাইমন কমিশন' (১৯২৭ খ্রিঃ) নিয়োগ করেছিল। বাস্তবক্ষেত্রে সাইমন কমিশনের পরিকল্পনা ভারতবাসীর ক্ষোভ প্রশমনের পরিবর্তে তাদের জাতীয় চেতনা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রেরণাকে জোরালো করেছিল। কোনো ভারতীয়কে এই কমিশনের সদস্য না-করায় ব্রিটিশের উন্নাসিক ও স্বৈরাচারী চরিত্র স্পষ্ট হয়েছিল। সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত ছিল অনভিপ্রেত। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ সরকারের এই প্রতিক্রিয়াশীল নীতি ভারতীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি প্রতিটি দল এই কমিশনের বিরোধিতা করে আবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। সর্বোপরি, ব্রিটিশ সরকারের এহেন উন্নাসিকতার প্রতিবাদে যুব সম্প্রদায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা বা স্বরাজের দাবি তোলে।

কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত:


১৯২৭-এ মাদ্রাজে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসলে ভারতের রাজনীতিতে নতুন মোড় আসে। এই অধিবেশনে কংগ্রেস দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- (১) সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করা এবং ভারতের জন্য একটি সংবিধান রচনার কাজ শুরু করা এবং (২) স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করা। কংগ্রেসের যুবনেতাদের চাপে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবটি গুরুত্ব পেয়েছিল। জওহরলালের প্রস্তাব অনুযায়ী কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে পূর্ণ স্বরাজের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অবশ্য গান্ধীজি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না।

পরবর্তীকালে তিনি কংগ্রেসের এহেন কঠোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। মাদ্রাজ কংগ্রেসের প্রথম প্রস্তাবটি সমর্থন করলেও, তিনি দ্বিতীয় প্রস্তাবটিকে 'অতি দ্রুত পরিকল্পনা ও চিন্তাহীন ভাবে গৃহীত' (hastly cenceived and thoughtlessly passed) বলে সমালোচনা করেন। পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে জওহরলাল প্রমুখের আবেগসর্বস্বতাকে তিনি নিন্দা করেন। জওহরলালকে তিনি জানিয়ে দেন যে, এভাবে তাড়াহুড়ো করার ফল ভালো হবে না। প্রত্যুত্তরে নেহরু স্বভাবসিদ্ধ ভাষাতে বলেছিলেন : “কোনো জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস মানতে পারে না।” গান্ধীজিকে তিনি একজন ‘রাগী শিক্ষক' বলে অভিহিত করে বলেন, “আপনি এমন একজন শিক্ষক যিনি আমাদের তাড়াবেন না বা চালনা করবেন না; কেবল মাঝেমধ্যে ভুল দেখাবেন।” অবশ্য মতান্তর হলেও গান্ধী- নেহরু সম্পর্কে মতান্তর ঘটেনি।

কলিকাতা অধিবেশন:


১৯২৮-এ দিল্লি, বোম্বাই ও লক্ষ্ণৌ শহরে সর্বদলীয় কমিটির অধিবেশনে নতুন সংবিধান ‘নেহরু রিপোর্ট' সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক চলে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে মতভেদের কারণে এই প্রয়াস অকার্যকর থেকে যায়। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের তরুণ সদস্যরা 'পূর্ণ স্বাধীনতার' দাবিতে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে ‘পূর্ণ স্বরাজ'-এর দাবিকে কেন্দ্র করে প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়। জওহরলাল, সুভাষচন্দ্র, সত্যমূর্তি প্রমুখ কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলেন।

ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ' গঠন করে এঁরা ইতিমধ্যেই পূর্ণ স্বাধীনতার সপক্ষে প্রচার শুরু করেছিলেন এবং যথেষ্ট জনমত তৈরিও করেছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি, মতিলাল প্রমুখ প্রবীণ সদস্যরা আপাতত “ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস”-এর দাবিতে অনড় থাকেন। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর প্রস্তাব ১৩৫০-৯৭৩ ভোটে গৃহীত হয়। গান্ধীর প্রস্তাব অনুযায়ী স্থির হয়। যে, জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে স্থির ও স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক বছর সময় দেবে।

এক বছর সময়সীমার মধ্যে যদি সরকার ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে কংগ্রেস পুনরায় অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবে এবং কংগ্রেসের লক্ষ্য হবে ‘পূর্ণ স্বরাজ' বা স্বাধীনতা। এইভাবে গান্ধীজি যুবাসদস্যদের সন্তুষ্ট করার একটা চেষ্টা করেন। জওহরলাল তাঁর স্বভাবসুলভ দ্বিধাগ্রস্ততার কারণে এই প্রস্তাব মেনে নেন। সুভাষচন্দ্র অবশ্য তীব্র ভাষায় এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে জানিয়ে দেন যে, দেশ যখন পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত, নেতারাই তখন দ্বিধাগ্রস্ত।

গান্ধীজির প্রস্তুতি:


যাই হোক, গান্ধীজি এক বছর সময়সীমা বাঁধলেও সম্ভাব্য আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করতে দেরি করলেন না। প্রস্তাবিত ইউরোপ সফর স্থগিত রেখে তিনি স্বদেশে গণসংযোগ কর্মসূচির পরিকল্পনা করেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, ভবিষ্যৎ সংগ্রামের স্বরূপ যাই হোক, তার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। অতঃপর তিনি বিহার, যুক্তপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা, ত্রিবাঙ্কুর, বাংলা, সিন্ধু প্রদেশ, দিল্লি, অন্ধ্র প্রভৃতি স্থানে পরিভ্রমণ করে জনসংযোগ সম্পাদন করেন।

ইতিপূর্বের সফরগুলিতে তিনি সাম্প্রদায়িক ঐক্য, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ইত্যাদি গঠনমূলক বিষয়ের উপর জোর দিতেন। কিন্তু বর্তমান সফরে গান্ধীজি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। সিন্ধুপ্রদেশে গান্ধীজি যুবসম্প্রদায়কে 'অগ্নি পরীক্ষার' জন্য প্রস্তুত হবার পরামর্শ দেন। কলিকাতায় তাঁর উপস্থিতিতে বিলাতি বস্ত্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

সরকার গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করলে সারা দেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং নানা স্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিলাতি বস্ত্র পোড়ানো চলতে থাকে। জাতীয় কংগ্রেসের ডাকে জনতার আন্দোলনের পাশাপাশি ১৯২৯-এ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপও নতুনভাবে সংগঠিত হতে থাকে। ভগৎ সিং কেন্দ্রীয় আইনসভা কক্ষে বোমা নিক্ষেপ করে গ্রেপ্তার বরণ করেন। দীর্ঘ অনশন চালিয়ে বিপ্লবী যতীন দাস মৃত্যুবরণ করেন। এর প্রতিবাদে সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত হলেও সরকার উপলব্ধি করতে পারে না যে, ভারতবাসী মানসিকভাবে বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।

শ্রমিক দল সরকার:


ইতিমধ্যে ১৯২৯-এর মে মাসে রামসে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে ব্রিটেনে শ্রমিক দলের সরকার ক্ষমতাসীন হলে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একটা মৃদু সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। নতুন মন্ত্রিসভার সাথে পরামর্শ করে বড়োলাট আরউইন ঘোষণা করেন যে, ১৯১৭-এর ঘোষণার অন্তর্নিহিত বক্তব্য অনুযায়ী ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস' অর্জনকে ভারতের অগ্রগতির স্বাভাবিক বিষয় বলে গণ্য করা হবে।

সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হবার পর ভারতীয় নেতাদের সাথে একটি গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হবারও প্রতিশ্রুতি তিনি দেন। বড়োলাটের এই ঘোষণা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতৃবৃন্দকে কিছুটা আশান্বিত করেছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র, সৈফুদ্দিন কিচলু প্রমুখ এই প্রস্তাবকে একটি ‘কৌশলজনক ফাঁদ' বলে পরিহাস করেন। যাইহোক, কংগ্রেস ‘দিল্লি ঘোষণা' প্রকাশ করে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস' অর্জনের শর্তে গোলটেবিল বৈঠকে বসার ইচ্ছা জানিয়ে দেন।

আরউইনের নেতিবাচক ঘোষণা:


কিন্তু ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতা ভারতীয় রাজনীতিতে আবার উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের নেতা উইনস্টন চার্চিল জানিয়ে দেন যে, ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস' প্রদান হবে এক 'গুরুতর অপরাধ'। বস্তুত এই সময় শ্রমিকদলের সরকার নানা কারণে রক্ষণশীল দলের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই ভারতের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সম্ভাবনা আবার স্বপ্নে বিলীন হয়ে যায়।

১৯২৯-এর ২৩ শে ডিসেম্বর গান্ধী, মতিলাল নেহরু, তেজবাহাদুর সপ্রু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বড়োলাট আরউইনের সাথে সাক্ষাৎ করে সরকারের মনোভাব জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, “এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।” প্রবীণ নেতৃবৃন্দের সমস্ত প্রত্যাশা শূন্যে বিলীন হয়ে যায়। হতাশ ও ক্ষুব্ধ গান্ধীজি জানিয়ে দেন যে, “আমার আর ফেরার পথ নেই। পূর্ণ স্বরাজের দাবি আমাকে সমর্থন করতেই হবে।” এইভাবে শেষ হল আলাপ-আলোচনার পর্ব, শুরু হল চরম সংঘাতের অধ্যায়।

আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area