(পঞ্চম অধ্যায়) মোগল সাম্রাজ্যের (প্রশ্ন ও উত্তর)
সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস || মোগল সাম্রাজ্য (পঞ্চম অধ্যায় ) প্রশ্ন ও উত্তর || Mogala Samrajyera Prasna And Uttara
1) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের কারণ কী ছিল?
উত্তরঃ 1526 খ্রিস্টাব্দে বাবর ও ইব্রাহিম লোদির মধ্যে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে বাবর জয়লাভ করেছিলেন। কারণ-
১) কামানের ব্যবহারঃ একদিকে গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের ব্যবহার এবং অন্যদিকে দ্রুতগামী অশ্বারোহী তিরন্দাজ বাহিনীর যৌথ আক্রমণে ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হয়েছিলেন।
২) রুমি কৌশলঃ ইব্রাহিম লোদির বাহিনীর বিরুদ্ধে বাবর 'রুমি' কৌশল অবলম্বন করেন। এই পদ্ধতিতে তিনি একাধিক গো-শকটের একটি প্রাচীর তৈরি করেন। তাঁর পিছনে মাটির ঢিবিতে কামান রেখে যুদ্ধ করেন।
৩) লোদির দুর্বলতাঃ ইব্রাহিম লোদির আমলে দিল্লির দরবারে অভ্যন্তরীণ গোেলােযােগ চলছিল। ফলে তার পরাজয় ঘটেছিল।
2) পানিপথের প্রথম যুদ্ধের গুরুত্ব লেখো।
উত্তরঃ একাধিক কারণে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হল-
১) মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা: পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের ফলে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটি এদেশে প্রায় 330 বছর টিকেছিল।
২) সুলতানি যুগের অবসান: ইব্রাহিম লোদির পরাজয়ের ফলে দিল্লির সিংহাসনে সুলতানি যুগের অবসান ঘটে।
৩) সামরিক সাফল্যঃ পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সুকৌশলী নেতৃত্ব এই যুদ্ধে মোগলদের সামরিক সাফল্যের অন্যতম কারণ।
3) 'পাট্টা' ও 'কবুলিয়ৎ' কী?
উত্তরঃ 'পাট্টা' ও 'কবুলিয়ৎ' ছিল শেরশাহের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে তিনি এই উ ব্যবস্থার রূপায়ণ করেন।
১) পাট্টাঃ কৃষককে তার জমির অধিকার সংক্রান্ত যে দলিল দেওয়া হত তাই পাট্টা নামে পরিচিত ছিল। এতে জমির পরিমাণ, কৃষকদের নাম ইত্যাদি লেখা থাকত।
২)কবুলিয়ৎঃ কৃষক সরকারকে রাজস্ব দেওয়ার যে অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করত সেটি কবুলিয়ৎ নামে পরিচিত ছিল।
4) আকবরের আমলের কোন্ রাজপুত বীর তোমাকে বেশি আকর্ষণ করে এবং কেন?
উত্তরঃ মোগল সম্রাট আকবর রাজপুতদের বিরুদ্ধে মৈত্রী ও যুদ্ধনীতি অবলম্বন করেছিলেন। প্রায় সমস্ত রাজপুত রাজ্য তাঁর বশ্যতা মেনে নিলেও মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ আমৃত্যু তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেননি। তাই আকবরের আমলে রাজপুত বীর রানা প্রতাপ সিংহের চরিত্রই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। এর কারণগুলি হল-
১)স্বাধীনচেতা রানা প্রতাপ সিংহ আকবরের মৈত্রী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
২) নিজেদের থেকে শক্তিশালী জেনেও মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
৩)1576 খ্রিস্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে রানা প্রতাপ সিংহ আকবরের কাছে হেরে গেলেও আজীবন মোগলদের বিরোধিতা করে যান।
5) আকবর রাজপুতদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন কেন?
উত্তরঃ রাজপুতরা ছিলেন শৌর্য-বীর্যে ভারতের গৌরবান্বিত একটি জাতি। এঁরা ছিলেন সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমী। আকবর ছিলেন দূরদর্শী সম্রাট। তিনি রাজপুতদের দক্ষতা প্রত্যক্ষ করে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আকবর বুঝতে পারেন, রাজপুতদের পাশে পেলে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত মজবুত হবে এবং প্রশাসন দৃঢ়তা লাভ করবে। তাই তিনি তাঁদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন।
6) টমাস রো কে ছিলেন? তিনি কোন্ মোগল সম্রাটের রাজসভায় এসেছিলেন?
উত্তরঃ টমাস রো ছিলেন ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ। তিনি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের রাজসভায় দূত হিসেবে এসেছিলেন।
7) খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তরঃ 1527 খ্রিস্টাব্দের 16 মার্চ বাবর ও রানা সংগ্রাম সিংহের মধ্যে খানুয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে বাবর জয়লাভ করেন।
1)গুরুত্বঃ
১) খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
২) মোগলরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করায় রাজপুতদের প্রাধান্য বিনষ্ট হয়।
৩) এই যুদ্ধ জয়ের ফলে মোগলদের রাজধানী কাবুল থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।
8) টীকা লেখোঃ দীন-ই-ইলাহি
উত্তরঃ মোগল সম্রাট আকবর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ধর্মালম্বী প্রজাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে 'দীন-ই-ইলাহি' নামে নতুন ধর্মনীতির সাহায্য নেন। তাঁর এই ধর্মনীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল উদারতা, সহিষনুতা, জনকল্যাণ এবং সকল ধর্মের সার পর্যালোচনা করা। দীন-ই-ইলাহি গ্রহণের পদ্ধতি ছিল খুব সহজ। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে এ যে-কেউ এই মতের অনুগামী হতে পারত। কিন্তু উদারতাবাদী নীতির সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও 'দীন-ই-ইলাহি' জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি এবং আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এটি বিলুপ্ত হয়। মোগল অভিজাতদের মধ্যে মাত্র ছাব্বিশ জন 'দীন-ই-ইলাহি' গ্রহণ করেন এবং হিন্দুদের মধ্যে কেবলমাত্র বীরবল এই 'ধর্মমত' গ্রহণ করেন।
9) পিয়েত্রা দুরা কী?
উত্তরঃ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে মারবেল পাথরের গায়ে ফুল, লতাপাতা খোদাই করে দেয়াল শোভিত করার শিল্পরীতি প্রভৃত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই শিল্পরীতিকে 'পিয়েত্রা দুরা' বলা হয়। এই শিল্পরীতির উদ্ভব কোথায় হয়েছিল সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে রোমে প্রথম এই শিল্পরীতির বিকাশ ঘটে। ভারতে এই শিল্পরীতির অন্যতম নিদর্শন দেখা যায় তাজমহলে।
10) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তরঃ 1556 খ্রিস্টাব্দে আকবর ও আফগান শাসক আদিল শাহের প্রধানমন্ত্রী হিমুর মধ্যে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে হিমু পরাজিত হন।
1) গুরুত্বঃ
১) এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত সুদৃঢ় হয়।
২) এই যুদ্ধজয়ের পরবর্তী পর্বে আকবর মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারে সাফল্য লাভ করেন।
৩) এই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে আফগানদের দিল্লি জয়ের স্বপ্ন ভেঙে যায়।
11) টীকা লেখোঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত।
উত্তরঃ মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় মোগল সাম্রাজ্য বিরাট অংশে বিস্তৃত হয়েছিল। ঔরঙ্গজেব এই সময় দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এর পশ্চাতে তাঁর একাধিক উদ্দেশ্য ছিল।
(ক) রাজস্ব বৃদ্ধিঃ দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মোগল আধিপত্য সুদৃঢ় হলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। ফলে মোগল অর্থনীতি মজবুত হবে।
(খ) মারাঠা দমনঃ এই সময় শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য ছিল মারাঠা প্রভাব খর্ব করে মোগল আধিপত্য সুদৃঢ় করা।
কিন্তু দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম স্বত্ত্বেও ঔরঙ্গজেবের কোনো উদ্দেশ্যই সফল হয়নি। উপরন্তু ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। শিবাজিকে স্বাধীন শাসক মেনে নিতে বাধ্য হন। ফলে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য অভিযান মোগল সাম্রাজ্যের পতনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। এই কারণে এই অভিযানকে দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলেও উল্লেখ করা হয়।
12) শেরশাহের সংস্কারগুলি লেখো।
উত্তরঃ মোগল সাম্রাজ্যের সাময়িক অবসান ঘটিয়ে শেরশাহ দিল্লিতে আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্য বিজেতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অসাধারণ সংগঠক ছিলেন। তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বহু সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন।
(ক) সামরিক সংস্কারঃ সেনাবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য তিনি 'দাগ' ও 'হুলিয়া' প্রথা চালু করেন।
(খ) রাজস্ব সংস্কারঃ রাজস্ব ক্ষেত্রে সংস্কারসাধনের জন্য তিনি কৃষকদের জন্য 'পাট্টা' ও রাষ্ট্রের কৃষককে জমি প্রদানের প্রমাণস্বরূপ 'কবুলিয়ত' প্রথার প্রবর্তন করেন।
(গ) যোগাযোগ সংস্কারঃ শেরশাহ সোনার গাঁ থেকে উত্তর পশ্চিম পেশোয়ার পর্যন্ত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেন।
(ঘ) ডাক যোগাযোগঃ শেরশাহ ঘোড়ার পিঠে ডাক যোগাযোগ চালু করেন। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়।
সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাসের আরও অধ্যায় থেকে প্রশ্ন ও উত্তর-