বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ প্রবন্ধ রচনা
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান পাঠক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষায় একটি করে প্রবন্ধ রচনা প্রশ্নপত্রে এসেই থাকে। শব্দসীমা ৫০০ এবং পূর্ণমান ১০। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কোনো উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে না কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে। এই নমুনা বাংলা প্রবন্ধরচনা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে আমরা মধ্য বিভাগের সকল শ্রেনীর বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রদান করবো। নতুন নতুন প্রশ্ন পেতে নিয়মিত আমাদের Website টি Follow করো। যাইহোক, বর্তমান পোস্টে প্রকাশিত “ বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ ” প্রবন্ধটি মূলত মাধ্যমিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ রচনা|| Bigyaner Agragati O Paribesh Sanrakshan bangla Rachana
বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা :
আগুনের গোলক থেকে পৃথিবী গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম হয়েছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের। ঠিক একই সময় হয়তো বিজ্ঞানেরও সূচনা হয়েছিল। তবে পাথরে পাথরে ঘর্ষণের মাধ্যমে উৎপন্ন আগুনের বিচ্ছুরণের মধ্যে দিয়েই আদি মানবের কাছে বিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ আর তখন থেকেই মানুষের হাত ধরে শুরু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথচলা।
এ পৃথিবীর বক্ষজুড়ে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছে। ঠিক তেমনভাবেই প্রকৃতির নাড়ির মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে নানান। বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা। এমনই বিভিন্ন জ্ঞান এবং সম্ভাবনার সঙ্গে মানুষের প্রথম সাক্ষাৎকারের পর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। ধীরে ধীরে মানুষ, প্রকৃতির মধ্যে প্রচ্ছন্ন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সূত্রের যেমন খোঁজ পেয়েছে, তেমনই প্রযুক্তির জগতেও সে অসাধ্য সাধন করেছে।
গ্যালিলিয়ো-নিউটনের যুগ পেরিয়ে আইনস্টাইন, জগদীশচন্দ্র বসু কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখের মতন অসামান্য প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিকদের উদ্ভাবনী কৌশল এবং মৌলিকতার জোরে মানুষ ঘোষণা করেছে মেধা ও মননের জয়ধ্বনি। শত-সহস্র রকমের যন্ত্র ও পণ্য আবিষ্কারের ফলে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আজ স্পর্শ করেছে উন্নতির শিখর। দৈনন্দিন জীবনে, শিক্ষায়, চিকিৎসায় নব নব উদ্ভাবন পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে টিভি, কম্পিউটার, ফোন।
এখনকার দিনে প্রযুক্তির কল্যাণেই সাত সমুদ্র-তেরো নদীর গণ্ডি উপেক্ষা করে মানুষ এক নিমেষে পৌঁছে যেতে পারে অপর প্রান্তের মানুষের কাছে, এমনকি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরেও মানুষ বিস্তার করেছে নিজের প্রভুত্ব। এভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা যেমন নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে, তেমনভাবে অন্যদিকে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষী মানুষের ঘৃণ্য বেহিসেবি আস্ফালনে অরণ্য-জনপদ-সভ্যতা যেমন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ধ্বংসাত্মক রূপকে প্রত্যক্ষ করেছে, দেখেছে মনুষ্যত্বর অপমৃত্যু তেমনই প্রতিমুহূর্তে এর অপব্যবহারের ফলে তিলে তিলে দূষিত ও বিষাক্ত হচ্ছে পৃথিবী। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে ভয়াবহ এক ভবিষ্যতের দিকে।
বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ ও বিপন্ন পরিবেশ :
আমরা সবাই জানি বাতাস এবং অক্সিজেন ছাড়া আমাদের জীবন অচল। মানুষ খাবার ছাড়া কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। জল না খেয়েও কিছুদিন প্রাণধারণ সম্ভব। কিন্তু বাতাস তথা অক্সিজেন ছাড়া কয়েক মিনিটও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির নাম করে আজ আমরা এই পৃথিবীকে যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছি, সেখানে প্রতিনিয়ত সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, বাতাস দূষিত করে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে উঠছি না তো? আমাদের পৃথিবীর অপূর্ব জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছি না তো! এই প্রশ্ন কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের পৃথিবীর সামনে সবথেকে বড়ো প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে। যে হারে দূষণ বাড়ছে তাতে এই পৃথিবীর আয়ু আর কত বছর? এর উত্তর আমাদের জানা নেই।
শিল্প বিপ্লব যেমন আশীর্বাদ, তেমনি আধুনিক দূষণের যাত্রাও সেখান থেকেই। কলকারখানায় ও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কয়লা, তেল, গ্যাসের ব্যবহার রাতারাতি বেড়ে চলল। বাড়তে থাকল কারখানার ধোঁয়া। কারখানার বর্জ্য এসে নদীতে পড়ে জলকে দূষিত করতে শুরু করল। লক্ষ লক্ষ যানবাহন চলতে শুরু করল আর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্যাসের উপস্থিতি বেড়েই চলল। গর্ত তৈরি হল স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন গ্যাসের আচ্ছাদনে। সেখান দিয়ে ঢুকতে শুরু করল সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করল।
মেরুর বরফ বেশি করে গলতে শুরু করল। মেরুর বরফগলা বাড়তি জল সমুদ্রে পড়ে ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিতে থাকল। ঠিকই, এসব একদিনে হয়নি। কয়েকশো বছর লেগে গেছে। কিন্তু বিপদ যে গতিতে এগিয়েছে, মানুষের সতর্ক হওয়ার গতি ছিল তার চেয়ে অনেক কম। ফলে বিপদ বেড়েই চলেছে, থেমে থাকেনি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার অনেক দ্বীপ ডুবে যাচ্ছে। সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপের কিছু অংশ এই কারণেই জলের নীচে চলে গিয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে।
কবি জীবনানন্দের রূপসি বাংলায় আমরা যে হেমন্তের বর্ণনা শুনি, সেই হেমন্তকালকে আজ আর আমরা এই দূষণের বাংলায় চিনতে পারি না। হেমন্ত হারিয়ে গিয়েছে দূষণের অন্ধগলিতে। 'এল নিনো'-র প্রতিক্রিয়ায় এখন ভারতে বর্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণ। যা এসে সরাসরি আঘাত করছে ফসলের উৎপাদনে। বজ্রপাত বেড়ে গেছে। বেড়েছে টাইফুন, সাইক্লোনের সংখ্যা। খবর আসছে অ্যাসিড বৃষ্টিরও। এর সঙ্গেই চলছে বৃক্ষ নিধন। বন কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। হাতি, বাঘ খাবারের অভাবে লোকালয়ে চলে আসছে।
নানা সংরক্ষণ আইন সত্ত্বেও বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কত পাখি নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে শহরের বুক থেকে। মাতৃক্রোড়ে জন্ম হয়। হচ্ছে অপরিণত শিশুর। কোন্ পথে চলেছি আমরা, এই প্রশ্ন উঠছে। জল, জঙ্গল, আকাশ, বাতাস, মাটি আমরা প্রতিদিনই দূষিত করে চলেছি নিজ হাতে। প্রকৃতি যখন এর চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিতে শুরু করবে তখন আমরা কী জবাব দেব, সেই উত্তর আমাদের জানা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা এ কোন্ পৃথিবী রেখে যাচ্ছি, জানা নেই সেই উত্তরও।
এই ভাবেই যদি চলতে দেওয়া হয়, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন ২০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নানা ধরনের দূষণজনিত মড়ক দেখা দেবে। ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওজোন আচ্ছাদনে গহ্বর সৃষ্টি হওয়ায় পৃথিবীতে ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দূষিত জল খেয়ে ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে মৃতের হার বেড়েই চলেছে।
পরিত্রাণের পথ :
এভাবেই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে প্রকৃতির প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। গাছ কেটে তৈরি হয়েছে নানা ফ্যাক্টরি, মোবাইল ফোনের সিগন্যাল টাওয়ারের জন্যে ক্ষতি হয়েছে বহু পশুপাখির। শুধু তাই নয়, এখনকার সবচেয়ে বড়ো চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিশ্ব উন্নায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এর ফলে পৃথিবীর তুষার চূড়ার বরফ গলে যাচ্ছে এবং ফলস্বরূপ পৃথিবীর বুকে জলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবেশের বুকে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীন উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিসর্বস্বতায় মানুষ যতই উপকৃত হোক না কেন, প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ভয়াবহ বিপর্যয়ে মানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই যুগের বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে নতুনভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন।
বিজ্ঞানের যে রূপে প্রকৃতি তার সামঞ্জস্য ফিরে পাবে আর মানুষও নিজেদের অগ্রগতির সুবিধা উপভোগ করতে পারবে, সেই প্রযুক্তিরই নাম 'ইকো-ফ্রেন্ডলি টেকনোলজি', অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি স্থাপন করে মানব সভ্যতার উন্নতি। এর ফলে তৈরি হচ্ছে নানা 'বায়ো-ডিগ্রেডেবল' জিনিস, যেগুলো প্রকৃতির কাছেই আবার ফিরে যেতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে সূর্যের রশ্মি এবং খোঁজ চলছে পরিবেশের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করে না, এমন বিভিন্ন বিকল্প শক্তির। বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা নিজের মতো করে পরিবেশবান্ধব হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। এটাই আশার কথা।
মনে রাখতে হবে পরিবেশ ধ্বংসের আঘাত প্রথমে পড়বে ভারতের মতো জনবহুল গরিব দেশে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে এই সব উন্নয়নশীল দেশেরই বেশি সক্রিয় হওয়া উচিত। এটা ঠিক, কয়েক দশক আগেও বিপদটা যত ভয়াবহ ছিল, আজ তার থেকে কিছুটা হলেও পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। দেশে দেশে পরিবেশ বাঁচানোর কঠোর আইনকানুন প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত আমরা, এমন দাবি করার জায়গা থেকে আমরা এখনও যোজন যোজন দূরে আছি। এই আক্ষেপ ও হতাশা থেকেই কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, 'আমাদের এই শতকের/বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু-বেড়ে যায় শুধুঃ/তবু কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময়/জ্ঞান নেই আজ পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।'-অর্থাৎ প্রয়োজন প্রযুক্তি এবং পরিবেশের মধ্যে এক অর্থপূর্ণ মানবীয় সম্পর্কের বন্ধন।
একমাত্র মানুষের পক্ষেই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে মানবতায় দীক্ষিত করে পৃথিবী ও পরিবেশকে স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। আমাদের কখনোই ভুললে চলবে না পরিবেশ ও বিজ্ঞান যেন একই মুদ্রার দুই দিক। তাই উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করেই উন্নতির চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব। আর একাজে শুধু বিজ্ঞানীরা নয়, সাধারণ মানুষও যদি হাত বাড়িয়ে দেয় এই মেলবন্ধনে, তবেই আগামী দিনে আমরা দেখতে পাব এক সুন্দর পৃথিবীকে।