বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন বাংলা রচনা
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান পাঠক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষায় একটি করে প্রবন্ধ রচনা প্রশ্নপত্রে এসেই থাকে। শব্দসীমা ৫০০ এবং পূর্ণমান ১০। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কোনো উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে না কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে।
এই নমুনা বাংলা প্রবন্ধরচনা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে আমরা মধ্য বিভাগের সকল শ্রেনীর বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রদান করবো। নতুন নতুন প্রশ্ন পেতে নিয়মিত আমাদের Website টি Follow করো। যাইহোক, বর্তমান পোস্টে প্রকাশিত "বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন" প্রবন্ধটি মূলত মাধ্যমিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন বাংলা রচনা || Bangla Lokasahitya O Samajajiban
বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন
ভূমিকা :
সমাজ ও সাহিত্যের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এককথায় উভয়ের মধ্যে এক পরিপূরকতার সম্পর্ক রয়েছে। তাই সাহিতা হল সমাজের আয়না। মানবচরিত্র এবং মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শী তলদেশ সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসের বর্ণময় অনুরণন শোনা যায় সাহিত্যের লোকায়ত আঙ্গিকে। এ কারণেই লোকসাহিত্যের গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, "প্রত্যেক দেশেই লোকসাহিত্যের ভিত্তির উপরেই লিখিত সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। যদিও লিখিত সাহিত্যধারা সৃষ্টি হইবার সঙ্গে সঙ্গেঙ্গই মৌখিক প্রচলিত লোকসাহিত্যের ধারাটি ক্রমে শুষ্ক হইয়া যাইতে থাকে, তথাপি বহুকাল পর্যন্ত তাহা একেবারে লুপ্ত হইয়া যাইতে পারে না।"
লোকজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ প্রভৃতির আশ্চর্য সাক্ষ্য বহন করে লোকসাহিত্য। মানুষ তার ফেলে আসা অতীতচারী জীবনের প্রাচীন সৌন্দর্য ও সুষমাকে লোকসাহিত্যের মধ্যে আবিষ্কার করে। বাংলার লোকসাহিত্য তাই বাঙালির সংস্কৃতির গৌরবময় অতীতের ঐতিহাসিক ভাষ্য।
লোকসাহিত্যের স্বরূপ ও বাংলা লোকসাহিত্য : আবহমানকাল হতে লোকমুখে প্রচারিত অলিখিত গান, ছড়া, গল্প প্রভৃতিকেই লোকসাহিত্য বলা হয়। এগুলি ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়। প্রাচীন যুথবদ্ধ গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় এদের সৃষ্টি। লোকমানসের ধর্ম, সংসার, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চিহ্ন ধারণ করে আছে লোকসাহিত্যের শরীর। মানবজীবনের চিন্তা-চেতনা ও শিল্পবোধের ফসল হল এই লোকসাহিত্য। মানবসভ্যতার গ্রামীণ সংস্কৃতির জটিল উন্মেষ ও উত্থান সমৃদ্ধ সামাজিক অগ্রগতির ইতিহাসের এক আশ্চর্য বহিঃপ্রকাশ লোকসংস্কৃতির মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। বাংলার বিচিত্র সমাজজীবনের মতোই তার লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রটিও বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।
গবেষকেরা এই বিপুল সম্ভারকে 'লোকচর্যা', 'লোকবিজ্ঞান' কিংবা 'লোকশ্রুতি' নামে অভিহিত করেছেন। তা যাইহোক লোকসাহিত্যের বিস্তারিত ক্ষেত্রটিতে প্রথমেই আসে লোকসংগীতের বা সংগীতের প্রসঙ্গ। এগুলি স্থান বা অঞ্চলভেদে নানা প্রকারের। যেমন ঝুমুর, টুসু, ভাদু, পাঁচালি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, সারিগান, জারিগান, কবিগান, বাউল, তরজা, রামায়ণীগান প্রভৃতি। এই বিভিন্ন ধরনের গানই হল বাংলা লোকসাহিত্যের মর্মবাণী। বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজের সামগ্রিক বিশেষত্ব যেন এই গানগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। এরপরেই আসে প্রচলিত প্রাচীন ছড়াগুলির কথা।
একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই লোকসাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে ছেলেভোলানো ছড়া সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর মতে এই ছড়াগুলির মতো প্রাচীন আর কিছুই নেই। শিশুদের জন্য দিদিমা-ঠাকুরমাদের মুখে মুখে প্রচলিত এই ছড়াগুলিতে গ্রামীণ সমাজের নানা দিক ফুটে উঠেছে। লোকজীবনের সামগ্রিক পরিচয়বাহী এই ধরনের ধাঁধা, ছড়া, ব্রতকথা, লোককথা ইত্যাদিই বাংলার লোকসাহিত্যের অমূল্য মণিমাণিক্য। পল্লির লৌকিক জীবনের সামগ্রিক ছবি এই লোকসাহিত্যে বাণীরূপ লাভ করেছে। তাদের জীবন, ভাবনা, বিশ্বাস, ধর্ম-সংস্কার এইসবই ধরা পড়েছে লোকসাহিত্যে। জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত যে শিক্ষা চিরকালীন, মানবজীবনের সেই প্রকৃত শিক্ষার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে এইসব ছড়া বা গানে যেমন-
"খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে।"
এই ছড়াটিতে বাংলার রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থার ঐতিহাসিক চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছে। বিশেষ করে বর্গি হাঙ্গামার ভয়াবহতা ও দুর্দশাটি প্রকট। অন্যদিকে প্রবাদগুলিতেও এইরকম বহু ছবি আঁকা আছে।
"যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পূর্ণ দেশ।"
বাংলার লোককথাগুলিতে গল্পরসের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। আর গীতিকাগুলিতে ঘটেছে নাটকীয়তা, কাহিনিধর্মিতা এবং সমাবেশ। গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার বিস্তারে এইসব লোকসাহিত্যের অসীম তাৎপর্য ছিল।প্রেমমনস্কতার বর্তমানে লিখিত সাহিত্যের বাড়বাড়ন্তে লোকসাহিত্য অনেকটাই বেশ কোণঠাসা। কিন্তু লোকসাহিত্যের শাশ্বত মূল্য ও আবেদন রয়েছে। তা সাধারণ মানবজীবনের প্রাণের কথা।
উপসংহার :
তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার 'লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা করে এর গবেষণা ও রক্ষণাবেক্ষণের পথকে সুগম করতে প্রয়াসী হয়েছে। এই লোকসাহিত্য বাঙালির জাতীয় ঐশ্বর্য। একে সর্বতোভাবে রক্ষা করলেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণধর্ম ও চারিত্রবৈশিষ্ট্য রক্ষিত হবে।