পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প বাংলা প্রবন্ধ রচনা
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান পাঠক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষায় একটি করে প্রবন্ধ রচনা প্রশ্নপত্রে এসেই থাকে। শব্দসীমা ৫০০ এবং পূর্ণমান ১০। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কোনো উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে না কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে।
এই নমুনা বাংলা প্রবন্ধরচনা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে আমরা মধ্য বিভাগের সকল শ্রেনীর বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রদান করবো। নতুন নতুন প্রশ্ন পেতে নিয়মিত আমাদের Website টি Follow করো। যাইহোক, বর্তমান পোস্টে প্রকাশিত "পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প " প্রবন্ধটি মূলত মাধ্যমিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প বাংলা প্রবন্ধ রচনা || poschimBangla hastasilpo Bangla Prabandha Rachana
পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প
ভূমিকা :
পশ্চিমবঙ্গের হস্তশিল্প আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। কেননা বাঙালির মননে ও মানসিকতায় এক আশ্চর্য শিল্পসুষমা লুকিয়ে রয়েছে। তাই তাঁর প্রতিটি কাজেই শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটে। সে মাটি দিয়ে যে মূর্তি গড়ে, সুতো দিয়ে যে কাপড় বোনে কিংবা অন্ধকার ঘরে বসে যে তৈজসপত্র বানায়-এ সবই কল্পনায়, নৈপুণ্যে এবং সৃষ্টিশীলতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাংলার নগণ্য গ্রামের কোনো এক ভাঙা কুঁড়ে ঘরে বসে, অজস্র অখ্যাত কারিগর তাঁদের হাতের সূক্ষ্ম মোচড়ে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তোলেন কত আশ্চর্য শিল্পবস্তু। এই জাদুকরেরা মাটি দিয়ে গড়েন টেরাকোটা, সামান্য সুতো দিয়ে জগদ্বিখ্যাত মসলিন, রেশম দিয়ে তসর, পেতলের তার দিয়ে ডোকরা কিংবা সামান্য মোষের শিং দিয়ে ঘর আলো করা কোনো অসামান্য পুতুল। বাংলার হস্তশিল্পের এই গৌরবময় ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের।
টেরাকোটা :
আজ আর রাজার হাতিশালে হাতি কিংবা ঘোড়াশালে ঘোড়া না থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে এখন পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়ার ছড়াছড়ি। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া-বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির ঘোড়া বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। মাটির সঙ্গে সামান্য বালি মিশিয়ে কুমোরের চাকিতে ঘুরিয়ে এই হাতি বা ঘোড়া তৈরি করা হয়। রোদে শুকনো গাছের পাতার রং ব্যবহার করা হয় এদের গায়ে। এরপর আগুনের তাপে পুড়িয়ে তৈরি হয় এক অনবদ্য শিল্পকীর্তি। এটি টেরাকোটা নামে পরিচিত। বাংলার অনেক মন্দিরের গায়ে এই পোড়ামাটির বা টেরাকোটার কাজ আমাদের মোহিত করে। বিশেষত মল্লরাজাদের আমলে তৈরি বিষ্ণুপুরের মন্দিরের টেরাকোটার কাজ পৃথিবী বিখ্যাত। পোড়ামাটির তৈরি অনেক দেবদেবীর মূর্তি আবার গ্রামাঞ্চলে পূজিত হয়ে থাকে।
ডোকরা :
বাংলা ডোকরার কাজে বিখ্যাত। দেশে-বিদেশে এই শিল্পের কদর আছে। ডোকরা শিল্পীদের দেখা যায় প্রধানত পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে এবং পশ্চিমবাংলায়। এই কাজে খুব পরিশ্রম হলেও, দারিদ্র্যপীড়িত ডোকরা শিল্পীরা ঠিকমতো পারিশ্রমিক পান না। কিন্তু অভাব-অনটন এবং আগুনের তাপে কাজ করতে করতে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া এই শিল্পীদের হাতের কাজে তার প্রভাব পড়ে না। বাঁকুড়ার বিকনা এবং বর্ধমানের গুসকরার দরিয়াপুর গ্রামের ডোকরার কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কাছে প্রথমে মোম দিয়ে হাতি-ঘোড়া কিংবা নানা দেবদেবীর মূর্তির ছাঁচ বা গহনা তৈরি করা হয়; সেখানে একটা ছিদ্র রাখা হয়। এরপর তার উপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে সবশেষে ছিদ্র দিয়ে ঢেলে দেওয়া হয় গরম তরল পিতল। এইভাবে তৈরি হয় পিতলের মূর্তি। একেই ফারসিতে বলে সিরে পরদৌ। বাংলায় বলে মোমের গলিত ধাতব বা ডোকরার কাজ।
কাঁথা :
বাংলার কাঁথা-শিল্প সব অর্থেই ব্যতিক্রমী। এখনও বাংলাদেশে নকশি কাঁথা বলে একটি বিশেষ ধরনের সেলাই করা কাঁথা পাওয়া যায়। কবি জসিমউদ্দীনের 'নকসী কাঁথার মাঠ' কবিতায় যা বিখ্যাত হয়ে আছে। বহু যুগ আগে আমাদের মা-ঠাকুরমার হাতেই এর জন্ম। শাড়ির পাড়ের সুতো ছুঁচে পরিয়ে নানা লতাপাতায় কাঁথাটিকে সাজিয়ে তোলা হয়। এই ধরনের কাঁথার প্রসঙ্গ মহাভারতেও উল্লিখিত আছে। ভারতীয় জাদুঘরে এবং গুরুসদয় মিউজিয়ামে এখনও প্রাচীন নকশি কাঁথার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলার অন্যান্য কুটির শিল্প :
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল আজও তার গরিমা ও আভিজাত্য নিয়ে বাংলার মাটিতে বিরাজ করছে। কিংবা নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল এখনও সারা বাংলায় স্বমহিমায় টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্ব। এই গ্রামের চৌদ্দোটি পরিবার বর্তমানে এই জীবিকা গ্রহণ করে ধরে রেখেছে পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্য। আবার বীরভূমের ইলামবাজারের গালা শিল্প আজও আপন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল। এ ছাড়া শোলার কাজ প্রায় সারা পশ্চিমবঙ্গেই হয়ে থাকে। এই কাজ বিদেশেও খুব সমাদৃত। বাংলায় নানা জায়গার জলাভূমিতেই শোলার গাছ হয়। নদিয়ার 'বাতেরবিল' শোলার গাছের ও কাজের জন্য বিখ্যাত। এই শোলার কাজ যারা করে তাদের বলা হয় মালাকার। একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় বাংলার গ্রামে-গঞ্জে শাঁখারিদের শঙ্খের কাজ, যা বাংলার হস্তশিল্পকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
বহরমপুরের কাঁসা-পিতল শিল্প বাংলার হস্তশিল্পের আর এক উজ্জ্বল নিদর্শন। লোকনৃত্যের সঙ্গে জড়িত মুখোশও বাংলার হস্তশিল্পের অন্য একটি ঘরানা। যদিও এখন 'ছৌ' নাচের মুখোশই সাধারণভাবে বেশি দেখা যায়। বাংলার পুথিচিত্র ও পটচিত্র শিল্পকলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে সম্ভ্রম ও স্বীকৃতি আদায় করেছে। বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির অনন্য ঐতিহ্যের প্রতীক। আর বাংলার তাঁত কিংবা তসর এখন এক সুপ্রতিষ্ঠিত ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। তবে হস্তশিল্পের এই সমস্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিকগুলি আপন ঐশ্বর্যে অম্লান থাকলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই অর্থনৈতিক মন্দা, ঔপনিবেশিক অপশাসন, মন্বন্তর এবং দুর্নীতির কবলে পড়ে হতশ্রী হতে শুরু করেছিল। এরপর স্বাধীন হল দেশ। বাংলা ভাগ হল। দরিদ্র শিল্পীরা হৃতগৌরব ফিরে পাওয়ার আশায় বসে থাকলেও, দারিদ্র্য এবং দিশাহীনতা তাদের পিছু ছাড়ল না।
উপসংহার :
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হয়। অর্থাৎ দেশকে জানার অর্থ দেশজ শিল্প-সংস্কৃতিকে জানা এবং তার সঙ্গে একাত্মবোধ করা। কারণ লোকসংস্কৃতির লক্ষণ হল প্রগতিশীল সর্বজনীনতা। একটি জাতি অনেক ঝড় ও ঝঞ্ঝা বুকে নিয়ে এগিয়ে চলে। কিন্তু সে তার শিরা-ধমনির মধ্যে অনাদিকাল ধরে বহমান সংস্কৃতিকে হারাতে পারে না। কেননা সংস্কৃতি বিলুপ্ত হলে সেই জাতিরই মৃত্যু ঘটে।
তাই সরকার হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের বিভিন্ন অনুদান, সমবায় গঠন এবং মেলা বা হাটের নিয়মিত আয়োজনের মাধ্যমে হস্তশিল্পীদের উৎসাহদানের চেষ্টা করছে। সরকারি স্তরে এদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। আশা করা যায় এইসব প্রচেষ্টা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিকে সবল ও সুন্দর পথে চালিত করতে সদর্থক ভূমিকা পালন করবে।