একটি কফি মগের আত্মকথা বাংলা প্রবন্ধ রচনা
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান পাঠক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষায় একটি করে প্রবন্ধ রচনা প্রশ্নপত্রে এসেই থাকে। শব্দসীমা ৫০০ এবং পূর্ণমান ১০। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কোনো উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে না কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে।
এই নমুনা বাংলা প্রবন্ধরচনা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে আমরা মধ্য বিভাগের সকল শ্রেনীর বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রদান করবো। নতুন নতুন প্রশ্ন পেতে নিয়মিত আমাদের Website টি Follow করো। যাইহোক, বর্তমান পোস্টে প্রকাশিত "একটি কফি মগের আত্মকথা" প্রবন্ধটি মূলত মাধ্যমিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
একটি কফি মগের আত্মকথা বাংলা প্রবন্ধ রচনা || Coffee Mug Atmokotha Bangla Prabandha Rachana
একটি কফি মগের আত্মকথা
ভূমিকা :
আমি সেরামিকের তৈরি এক অতি সাধারণ কফি মগ। আমার ধবধবে সাদা গায়ের রং দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। আমি রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট দোকানের সুন্দর শোকেসে যত্নসহকারে সজ্জিত ছিলাম। অনেক লোক আমাকে দেখতে আসত, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করত। তাতে আমার বেশ ভালোই লাগত। দোকানি রোজ আমায় কাপড়ের ঝাড়ন দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিত। তখন জৌলুসে, রূপের গর্বে আমি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতাম।
ইতিহাস :
আমি জন্মেছিলাম বেহালার এক পটারিতে। ওই পটারিতে সেরামিকের অনেক জিনিসপত্র তৈরি হয়। হঠাৎ ওই কারখানার মালিকের খেয়াল হল কয়েকটা সাদা মগ বানিয়ে তাতে কিছু লিখে দেবেন। এই উদ্দেশ্যে একসঙ্গে বারোটা সাদা মগ চে তৈরি হল। এক দুই করে প্রত্যেকের গায়ে কয়েদিদের মতো নম্বর বসানো হচ্ছিল। আমার গায়ে '১২' নম্বর বসানোর আগে মালিক বললেন-'না থাক। এটিকে একদম ধবধবে সাদাই থাকতে দাও।' সবাই জানতে চাইল, 'কেন?' উনি হেসে বললেন, 'সাদা মগের সৌন্দর্য আর আভিজাত্যই আলাদা।' তারপর বেহালার কারখানা থেকে বেরিয়ে বহুপথ পেরিয়ে, আমি এই দোকানে ঠাঁই পেয়েছি।
হাতবদল :
একদিন একটি ছোট্ট মেয়ে তার বাবা-মার হাত ধরে দোকানে এল। নানা রকম জিনিস দেখতে দেখতে হঠাৎ তার নজর পড়ল আমার দিকে। সে দোকানদারকে অনুরোধ করল, আমাকে শোকেস থেকে বাইরে এনে তার হাতে দেওয়ার জন্য। মেয়েটির বাবা তাকে টুকাই বলে সম্বোধন করে, তার কোনো জিনিস পছন্দ হয়েছে তা জানতে চাইলেন। তখন ছোট্ট টুকাই হাতে নিয়ে আমাকে দেখাল। আমার তো খুব আনন্দ হল। আমি বুঝলাম এবার কাচের প্রাসাদে বন্দিত্বের দিন শেষ। আজ নতুন দেশে যাওয়ার পালা। তারপর তারা আমায় কিনে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন।
নতুন জীবন :
এরপর শুরু হল আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। টুকাই আমাকে বাক্স থেকে বের করে তার বাড়ির শোকেসে সাজিয়ে রাখল। আমার ওপরে ধুলোর আস্তরণ যাতে না পড়ে, তার জন্য সে আমায় প্রায় প্রতিদিনই পরিষ্কার করত। তবে আমার মনটা একটু হাঁকপাঁক করত। এ তো দোকানে সাজিয়ে রাখার মতোই আরেক রকমের বন্দিদশা। আমি চাইতাম মানুষের হাতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে। এ জীবন থেকে মুক্তি পেতে। হঠাৎ একদিন টুকাইয়ের খেয়াল হল আমার গায়ের ওপরে সে তার নিজের ছবি লাগাবে। আমায় চেহারার বদল ঘটবে ভেবে, আমিও পুলকিত হয়ে উঠলাম। সত্যিই টুকাইয়ের মুখ বসে গেল আমার গায়ে। এখন ও আর আমায় কাছছাড়া করে না। ফলে আমার বন্দিদশা ঘুচল। এখন টুকাই, ওর আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবকেও ডেকে ডেকে আমায় দেখায়। তখন আমার লজ্জা হলেও, বেশ ভালো লাগে।
পরিণাম :
এভাবে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। টুকাইও এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। তার এখন পড়াশোনার প্রচুর চাপ। আমাকে দেখার কিংবা যত্ন করার সময় এখন তার নেই। বরং আমার গায়ে নিজের ছোটোবেলার ছবি দেখে এখন সে হেসে ফেলে। সেই ছোট্ট টুকাইয়ের আজকের এই ব্যস্ততা দেখে আমিও নিজের মনে হাসি। সারাক্ষণ আমার চোখ দুটো যেন টুকাইকেই খুঁজে বেড়ায়। টুকাইয়ের আনন্দে আমি আনন্দিত হই, আর টুকাইয়ের দুঃখে আমারও মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে। আমাকে সবচেয়ে পীড়িত করে টুকাইয়ের অনুপস্থিতি। আসলে আগে তো টুকাই এত বাইরে যেত না। এখন বড়ো হওয়ায় নানা কাজে বাইরে যায়। তখন আমার ভীষণ একলা লাগে। আমার গায়ের ছোট্ট টুকাইটাও যেন কেঁদে ফেলে।
কিন্তু কিছুই তো করার নেই, শুধু অপেক্ষা। একদিন টুকাইয়ের এক বান্ধবী বাড়িতে এল। ওদের আমোদ-আহ্লাদ-ছটফটানি দেখে, আমিও আনন্দে অস্থির। এই তাড়াহুড়োর উত্তেজনাতেই বোধহয় আচমকা টুকাইয়ের হাত ফসকে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। আচ্ছন্ন অবস্থায় ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে দেখলাম, টুকাইয়ের চোখ ছলছল করছে।
আমার কোনো কষ্ট বা অভিমান নেই টুকাই। এ তো নিছক অনিচ্ছাকৃত। শুধু মনে পড়ছে আমার সঙ্গে তোমার কতদিনকার বন্ধুত্ব। কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। আমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া শরীরে যেন মনে হল, টুকাইয়ের চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদে মাখা। তবু যাওয়ার আগে আমার মনটা যেন গরম পানীয়ে উথলে উঠল। তোমার কাছে আমি চোখের জলে ভেজা এত বড়ো বিদায় পাব ভাবতে পারিনি টুকাই, আমার জীবন সার্থক।