কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পাঁচটি সেরা স্বাধীনতা দিবসের কবিতা
স্বাগত দর্শক বৃন্দ আজকের এই পোস্ট স্বাগতম। আজকে আমি তোমাদের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পাঁচটি সেরা কবিতা শেয়ার করলাম।
১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস, যা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির স্মরণে উদযাপন করা হয়। এই দিনটি ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা উপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশের প্রতীক।
প্রতি বছর ১৫ আগস্ট দিনটি সারা ভারত জুড়ে উদযাপিত হয়। দিল্লির লাল কেল্লায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। এই অনুষ্ঠানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস এবং সামাজিক সংগঠনগুলোতে পতাকা উত্তোলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের উপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
১৫ আগস্ট আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা সহজে অর্জিত হয়নি। অসংখ্য দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগ, ত্যাগ এবং নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই আমরা আজকের স্বাধীনতা পেয়েছি। এই দিনটি আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং জাতীয় একতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং আমাদের জাতির উন্নয়নের জন্য একত্রে কাজ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আসে।
কাজী নজরুল ইসলাম তত্কালীন সমাজকে তার কবিতার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্ধন জোগায়।আর দেরি না করে স্বাধীনতা দিবস নিয়ে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি সেরা কবিতা দেখে নিয়। কবিতা গুলি সুন্দরভাবে লিখিত আকারে নিচে দেওয়া হল।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পাঁচটি সেরা স্বাধীনতা দিবসের কবিতা
কাজী নজরুল ইসলামের "বিদ্রোহী" কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। পুরো কবিতাটি এখানে তুলে ধরা হলো:
১. বিদ্রোহী
কাজী নজরুল ইসলাম
বল বীর –
চির উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল উন্মাদ,
বল, নৃশংস!
মম তেজঃসম, শ্লথশান্ত,
মম নিষ্ফল কল্পান্তে হোক তবু মম মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত!
রক্তপিপাসা কল্পান্ত শেষে যদি ক্লান্ত মম দুর্জয় ললাট,
মম রক্ত-অশ্রু-সিক্ত আঁখি তবু নির্ভীক নির্লজ্জ থিবি স্থির
থাক্বে আঁখির জ্বলন্ত অগ্নিশিখা!
মোর প্রণয়-যুদ্ধ আঁখির আগুনে সিঁধিয়ে গিয়েছে সর্বান্তঃ
জীবন দীপের আলো-আঁধারি লেগেছে দেহে!
বিকল শিরা-উপশিরা ভেদি তবু অবিশ্রান্ত
জ্বলছে মোর চিরঞ্জীব অতৃপ্ত রক্তের অনলশিখা!
তোমার গায়ে আমার জীবন দান,
তোমার মূর্তিতে আমার কর-বিজরিত মাথা!
তবু দগ্ধ রক্ত-আঁখির মাঝারে থাকবে জাগ্রত
চিরবিজয়ী বীরের গর্বিত অট্টহাস্য!
বল বীর –
বল, মহা-বিদ্রোহী মহাকাল –
আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে বের হয়ে আসুক রুদ্র ভৈরব,
হউক অগ্নি-স্নান প্রলয়ঙ্কর,
দিগন্তরে মিলাক শ্রাবণের ঝড়!
বল বীর –
চির উন্নত মম শির!
২.চির উন্নত মম শির
কাজী নজরুল ইসলাম
চির উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
বজ্র আদল হানিছে দুর্জয়, তবুও মম মস্তক-অবিচল!
পৃথিবীর ঘুমায়ে আছি ভূমির বুকে স্বপন সমাধির।
মৃত্যু-ঘুম ভাঙিছে শুনি তোর বাণী,
অসীমে বাজিছে আজ মোর বিজয়-
বহি পৃথিবীর বিজয়-কেতন-
নভো-সীমায় দুর্জয়, বরাভয়, বিরামহীন!
ধরা অম্বর মোর পায়ে মোর সেবা-সপা’ ভুমি-অটুট-
শক্তি অটুট-
নির্ভীক হৃদয়ে উচ্চ করি’ শির নবীনে-পুরাতনে আমি।
তোমারে চিনি, ওগো বিদ্রোহী-
শুধুই বিদ্রোহী আমি।।
তুমি চির উন্নত মম শির-
ঐ শিখর হিমাদ্রির।
শির নেহারি’ মমি’র মত শির ঐ নেহারি’ শিখর
শত সহস্র তবুও।
৩. স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ইসলাম
হে স্বাধীনতা! তুমি কী কেবল দুখেরই কান্না?
তুমি কী কেবল শোণিতেরই মঞ্জরি?
তুমি কী কেবল বিপুল বিসর্জনের অঞ্জলি,
পূজারিণী-নীরব অভিমানিণী?
তবে কেন, হে মুগ্ধ জাননী,
তোমার মুখপানে চাহিয়া হাসিয়া
ধরণী আকাশ বাতাস?
তুমি নাহয় কেবলি সন্ধ্যার লগ্নে
অধীর আরক্ত একা যামিনীর
পূর্বাভাস!
তুমি কী কেবল মৃত্যুর অধিক মূল্যবান?
তবে কেন জীবনের রৌদ্র-মল্লিকায়
তোমার প্রেম-কুসুম?
তুমি কী কেবল প্রেত-মরনের
তন্ত্র-মন্ত্র মুকুর?
তবে কেন বুকে আজিও বাজিছে
তোমার মেঘ-মাদল?
তুমি মাভৈঃ, তুমি মরণোত্তীর্ণ গম্ভীর সঙ্কল্প,
তোমাতে মগ্ন আমিও অহংকার!
তুমি যজ্ঞের আকাশে কুন্ডলী,
সিদ্ধিদাতা, প্রভাতী জাগরণ!
তুমি স্বাধীনতা, তুমি মাভৈঃ
তুমি আমাদের গম্ভীরতম মন্ত্র,
তুমি মাভৈঃ!
৪.কান্ডারী হুশিয়ারি
কাজী নজরুল ইসলাম
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।
ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!
৫.নব-ভারতের হলদিঘাট
কাজী নজরুল ইসলাম
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট,
উদয়-গোধূলি-রঙে রাঙা হয়ে
উঠেছিল যথা অস্তপাট।
আ-নীল গগন-গম্বুজ-ছোঁয়া
কাঁপিয়া উঠিল নীল অচল,
অস্তরবিরে ঝুঁটি ধরে আনে
মধ্য গগনে কোন পাগল!
আপন বুকের রক্তঝলকে
পাংশু রবিরে করে লোহিত,
বিমনানে বিমানে বাজে দুন্দুভি,
থরথর কাঁপে স্বর্গ-ভিত।
দেবকী মাতার বুকের পাথর
নড়িল কারায় অকস্মাৎ
বিনা মেঘে হল দৈত্যপুরীর
প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত।
নাচে ভৈরব, শিবানী, প্রমথ
জুড়িয়া শ্মশান মৃত্যুনাট, –
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব ভারতের হলদিঘাট।
অভিমন্যুর দেখেছিস রণ?
যদি দেখিসনি, দেখিবি আয়,
আধা-পৃথিবীর রাজার হাজার
সৈনিকে চারি তরুণ হটায়।
ভাবী ভারতের না-চাহিতে আসা
নবীন প্রতাপ, নেপোলিয়ন,
ওই ‘যতীন্দ্র’ রণোন্মত্ত –
শনির সহিত অশনি-রণ।
দুই বাহু আর পশ্চাতে তার
রুষিছে তিনটি বালক শের,
‘চিত্তপ্রিয়’, ‘মনোরঞ্জন’,
‘নীরেন’ – ত্রিশূল ভৈরবের!
বাঙালির রণ দেখে যা রে তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠি, জাঠ!
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
চার হাতিয়ারে – দেখে যা কেমনে
বধিতে হয় রে চার হাজার,
মহাকাল করে কেমনে নাকাল
নিতাই গোরার লালবাজার!
অস্ত্রের রণ দেখেছিস তোরা,
দেখ নিরস্ত্র প্রাণের রণ;
প্রাণ যদি থাকে – কেমনে সাহসী
করে সহস্র প্রাণ হরণ!
হিংস-বুদ্ধ-মহিমা দেখিবি
আয় অহিংস-বুদ্ধগণ
হেসে যারা প্রাণ নিতে জানে, প্রাণ
দিতে পারে তারা হেসে কেমন!
অধীন ভারত করিল প্রথম
স্বাধীন-ভারত মন্ত্রপাঠ,
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
সে মহিমা হেরি ঝুঁকিয়া পড়েছে
অসীম আকাশ, স্বর্গদ্বার,
ভারতের পূজা-অঞ্জলি যেন
দেয় শিরে খাড়া নীল পাহাড়!
গগনচুম্বী গিরিশের হতে
ইঙ্গিত দিল বীরের দল,
‘মোরা স্বর্গের পাইয়াছি পথ –
তোরা যাবি যদি, এ পথে চল!
স্বর্গ-সোপানে রাখিনু চিহ্ন
মোদের বুকের রক্ত-ছাপ,
ওই সে রক্ত-সোপানে আরোহি
মোছ রে পরাধীনতার পাপ!
তোরা ছুটে আয় অগণিত সেনা,
খুলে দিনু দুর্গের কবাট!’
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।