জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা বাংলা রচনা
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান পাঠক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষায় একটি করে প্রবন্ধ রচনা প্রশ্নপত্রে এসেই থাকে। শব্দসীমা ৫০০ এবং পূর্ণমান ১০। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কোনো উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে না কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরসংকেত দেওয়া থাকে।
এই নমুনা বাংলা প্রবন্ধরচনা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে আমরা মধ্য বিভাগের সকল শ্রেনীর বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রদান করবো। নতুন নতুন প্রশ্ন পেতে নিয়মিত আমাদের Website টি Follow করো। যাইহোক, বর্তমান পোস্টে প্রকাশিত "জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা" প্রবন্ধটি মূলত মাধ্যমিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা বাংলা রচনা || Jiboncarita Pathera Prayojaniyata
জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা
ভূমিকা :
"জীবন লইয়া কী করিব? কী করিতে হয়?” বঙ্কিমচন্দ্রের এই প্রশ্ন, আসলে তো প্রত্যেকটি মানুষের প্রশ্ন। আমস্থ এমন দুর্লভ মানুষজন্ম গ্রহণ করেছি সে কি এমনি? এই জীবন নিয়ে কী করব, কী করতে হয়-সদাই এই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘোরে। রামপ্রসাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন-'এমন, মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।' এই মহার্ঘ জীবনকে কি পতিত করে রাখব? নাকি এ জীবনকে সাধনার শস্যে সার্থক করে তুলব। কিন্তু উপায় কী? মহাভারতে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন, 'কঃ পন্থা?' অর্থাৎ পথ কী? উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, 'মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা।' এর স্বর্ণ মহৎপ্রাণ মানুষেরা যে পথে গমন করেছেন।
তাই এই পৃথিবীতে যে মানুষ, সকলের শুভ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক-অপরাজেয় পৌরুষের অধিকারী-মনুষ্যত্বের সাধক; তাঁদের জীবন ও জীবনভাবনাই আমাদের প্রতিনিয়ত পথ দেখায়। তাঁদের মহৎ জীবনের কথা স্মরণ করে আমরা সংগ্রহ করি চলার পাথেয়, দিশাহীনতার অন্ধকার থেকে আলোকরেখার সন্ধান পাই। এক বাঙালি কবির কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে এই কথারই প্রতিধ্বনি-"মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে ক'রে গমন/হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,/সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয়কীর্তি ধ্বজা ধরে/আমরাও হব বরণীয়।"
জীবনচরিত পাঠের প্রাসঙ্গিকতা :
ভালো খেলতে হলে যেমন দক্ষ খেলোয়াড়ের খেলার পদ্ধতি জানা দরকার, ভালোভাবে অভিনয় করতে গেলে যেমন প্রকৃত অভিনেতার কাছে পাঠ নিতে হয়, তেমনই সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে মনীষীদের জীবন থেকে শিক্ষালাভ করতে হয়। জীবনচরিত পাঠের প্রাথমিক উপযোগিতাটুকু এইখানেই নিহিত থাকে। আমরা আত্মগঠনের প্রয়োজনীয় সমিধ তাঁদের জীবনের মধ্যেই খুঁজে পাই। মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে কপিলাবস্তুর শাক্যবংশীয় যুবরাজ পথে নেমে এসেছিলেন, মানুষের চেতনার ত্রাণকর্তা হয়ে জিশুখ্রিস্ট আত্মদানেও কুণ্ঠিত হননি; মহম্মদ পৃথিবীকে দেখিয়েছিলেন জাতিভেদহীন সামাজিক সাম্যের স্বপ্ন।
একইভাবে শ্রীচৈতন্য-কবির-নানক থেকে শুরু করে শ্রীরামকৃয়-বিবেকানন্দ মানুষকে সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবাসার শিক্ষা দিতে গিয়ে সর্বত্যাগী হয়েছেন। নিজ লক্ষ্যে স্থির থাকতে গিয়ে অবিশ্বাসীর আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন জোন অব আর্ক। তেমনি মাটিন লুথার থেকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর কিংবা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল বা ভগিনী নিবেদিতা বা ক্ষুদিরাম- সূর্যসেন-গান্ধিজি ও নেতাজিদের-জীবনের টুকরো কাহিনি আজ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। লোকপুরাণের মতো আকাশে- বাতাসে কান পাতলেও যেন তাঁদের সম্পর্কিত নানান গল্পকথা শোনা যায়। কিন্তু এ সবই তো তাঁদের জীবনের পরিণাম। মনে রাখতে হবে, পরিণাম নয় আমাদের বিবেচনায় পথটিই হল আসল। কারণ আমরা সকলেই হয়তো ঈশ্বরচন্দ্র বা মহাত্মা গান্ধি হব না। কে কী হতে পারব তা আগে থেকে স্থির করাও সম্ভব নয়। তবে এদের জীবনের আসল শিক্ষা হল জীবনের সত্য-স্বরূপ এবং চলার পথটিকে চিনে নেওয়া।
কোন্টা মনুষ্যত্ব আর কোন্টা নয়, কিংবা কোল্টা গ্রহণ করব আর কোল্টা বর্জন এইটুকু স্থির করে নেওয়ার জীবনে বড়ো প্রয়োজন আছে। এই জন্যেই রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষকে অনেক সাধনায় মানুষ হতে হয়। জীবনের চলার পথে ছোটোবড়ো আঘাত, অপবাদ, ছলনা, বঞ্চনা ও অকৃতজ্ঞতাকে অমিত শক্তির উৎসে রূপান্তরিত করতে জানতে হয়। লাঠি হাতে ধাবমান শীর্ণ, প্রত্যয়দৃপ্ত বৃদ্ধটিকে দেখে যখন 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে' শুনি, তখন আমরা জীবনের একাকিত্ব ও বেদনাকে প্রকৃত ভালোবাসতে শিখি।
উপসংহার :
কেবল শিক্ষালাভ করার জন্যেই জীবনচরিত পাঠ করব এমনটা কিন্তু সত্যি নয়। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ এক মহাজীবনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ লাভ করাই হল এর উদ্দেশ্য। তাঁকে এক মুহূর্তে বুঝে ফেলার স্পর্ধাটুকু দূরে সরিয়ে, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করে এই তুচ্ছ-ক্ষুদ্র জীবনকে কীভাবে অনন্ত জীবনে পর্যবসিত করা যায়, সেই উপলব্ধি মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলাই হল জীবনচরিত পাঠের মূল অভিপ্রায়। যেন মানবজীবনের মহিমাকে সমগ্রভাবে অনুভব করে বারবার নতুন করে জেগে ওঠা। জেগে উঠে একজন মানুষকে স্পষ্টরূপে দেখা আর তাঁর মধ্যে নিজেদের সত্যমূর্তিকে আবিষ্কার করার মধ্যেই জীবনচরিত পাঠের সার্থকতা প্রতিভাত হয়।