Ads Area


ভারতে বেসান্ত ও তিলকের হোমরুল আন্দোলনের বিবরণ দাও

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে ভারতে বেসান্ত ও তিলকের হোমরুল আন্দোলন সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

ভারতে বেসান্ত ও তিলকের হোমরুল আন্দোলনের বিবরণ দাও

ভারতে বেসান্ত ও তিলকের হোমরুল আন্দোলনের বিবরণ দাও।


উত্তর-

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পরবর্তীকালে হোমরুল আন্দোলন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তিভুক্ত দেশগুলি স্ব স্ব উপনিবেশগুলিকে যুদ্ধাবসানে স্বায়ত্তশাসন দানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা ছিল কথার কথা মাত্র। তাই বিশ্বযুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক দেশগুলির জনতা বিদেশি শোষকদের ওপর নতুন করে আঘাত হানতে মনস্থ করে। ভারতবর্ষও ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা ভারতবাসীকে চরমপন্থী আন্দোলনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে।

নরমপন্থী নেতাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষ। এই সময়ে ফিরোজ শা মেহেতা, গোপালকৃষ্ণ গোখলে প্রমুখ নেতার মৃত্যু ঘটলে নরমপন্থী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধজনিত অর্থনৈতিক সংকট এবং সোভিয়েত রাশিয়ার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিস্তৃতি ভারতবাসীর মধ্যে ইংরেজবিদ্বেষ বৃদ্ধি করে এবং অধিকতর সংগ্রামমুখী করে তোলে। ভারতীয় রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে বালগঙ্গাধর তিলক কারামুক্ত হয়ে পুনরায় রাজনীতির অঙ্গনে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হন অ্যানি বেসান্ত। এঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে হোমরুল আন্দোলন।

অ্যানি বেসান্ত:


অ্যানি বেসান্ত ভারতীয় রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন একজন থিয়োজফিস্ট। তিনি 'দি কমন উইল' নামক সাপ্তাহিক বা নিউ 'ইন্ডিয়া' নামক দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। আয়ারল্যান্ডের হোমরুল আন্দোলনের আদর্শে উদ্‌বুদ্ধ হয়ে অ্যানি বেসান্ত ভারতে 'হোমরুল লিগ' প্রতিষ্ঠা করেন (সেপ্টেম্বর, ১৯১৬ খ্রিঃ)।

তিনি জানতেন, হোমরুল আন্দোলনের তাৎপর্য ও গভীরতা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার ও জনগণ অনেক বেশি অবহিত। তাই ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সমতা রেখে তিনি ভারতেও হোমরুল আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। অ্যানি বেসান্ত ভারতবাসীর স্বশাসনের দাবিকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই এই নতুন আন্দোলনের সূচনা করেন।

তিনি কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী যুবকদের গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে পুনঃসঞ্জীবিত করা। বস্তুত তাঁর হোমরুল আন্দোলন কোনো নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেনি। তবে তাঁর এই উদ্যোগের ফলে সমগ্র দক্ষিণ ভারত এবং এলাহাবাদ, কানপুর, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি স্থানে গণ-আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।

তিলক:


হোমরুল আন্দোলনের আর একজন প্রবক্তা ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক। নরমপন্থী পরিচালিত কংগ্রেস সেই সময় কেবলমাত্র একটি প্রস্তাব গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তিলক তাই ভিন্ন কোনো আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে গতি আনতে চেয়েছিলেন। বেলগাঁও'তে অনুষ্ঠিত বোম্বাই-এর প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি 'হোমরুল লিগ' প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন (১৯১৬, এপ্রিল)।

তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ইন্ডিয়ান হোমরুল লিগ'। তিলক হোমরুল আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে স্বরাজ অর্জন এবং সেই লক্ষ্যসাধনে জনগণকে উদ্‌বুদ্ধ করাই তাঁর উদ্দেশ্য।” জাতীয় কংগ্রেসের সাথে হোমরুল লিগের তুলনা করে তিলক বলেন যে, “কংগ্রেস হল একটি বক্তৃতামঞ্চ এবং যার প্রধান কর্মসূচি হল প্রস্তাব গ্রহণ; অন্যদিকে হোমরুল লিগ হল জনগণকে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে শামিল করার একটি সংস্থা।”

তিলকের বক্তব্য দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। পশ্চিম-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি সভা সমিতি, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত সংগঠিত করেন।

বিভিন্ন সভায় তিলক দৃপ্তকণ্ঠে বলেন: "All are demanding Swaraj now, and the British can no longer resist the demand." উভয় লিগের সম্পর্ক ও সংগঠন : তিলক ও বেসান্ত আলাদা আলাদা ভাবে 'হোমরুল লিগ' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কখনো সংঘাত হয়নি। কারণ এঁরা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক।

তাছাড়া উভয়ে আলাদা আলাদা অঞ্চল স্থির করে নিয়েছিলেন। তিলকের কর্মক্ষেত্র ছিল বোম্বাই (মুম্বাই) বাদে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ ও বেরার। অ্যানি বেসান্তের কর্মক্ষেত্র ছিল এর বাইরের সমগ্র ভারতবর্ষ। উভয় লিগেরই সদস্য সংখ্যা ছিল প্রচুর। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের হিসেব অনুযায়ী তিলকের লিগে ছিল ৩২ হাজার সদস্য আর বেসান্তের লিগের সদস্য সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার। উভয় লিগের একসাথে কাজ না করার কারণ হিসেবে বেসাক্ত বলেন, "Some of his (Tilak 's) followers disliked me (Besant) and some of mine disliked him. We, however, had no quarrel with each. other: " উভয় লিগই যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল, তবে তিলকের লিগ ছিল অপেক্ষাকৃত সুসংগঠিত।

যদিও বেসান্তের লিগের শাখা ছিল ২০০টি, কিন্তু সবকটি সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। লিগের সমস্ত কার্যাবলী পরিচালিত হত মাদ্রাজের 'অডিয়ার' থেকে। কার্য পরিচালনার জন্য সাত জন সদস্যবিশিষ্ট একটি কার্যনির্বাহক সমিতি ছিল। তবে বেসান্ত আর্নডেল, সি. পি. রামস্বামী ও বি. পি. ওয়াদিয়া -এই তিন জন সদস্যের দ্বারাই প্রধানত কার্য পরিচালনা করতেন।

তিলক মহারাষ্ট্র সফর করে হোমরুলের আদর্শ জনপ্রিয় করে তোলেন। হোমরুল আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে তিলক একদিকে স্বরাজ দাবি করেন, অন্যদিকে তিনিই প্রথম ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগঠনের প্রস্তাব দেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও তিনি তুলে ধরেন। অব্রাহ্মণদের দাবির প্রতিও তিনি সকলকে ধৈর্যশীল হতে পরামর্শ দেন ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের ওপর জোর দেন। তিনি বলতেন, ইংরেজ শাসনে ব্রাহ্মণ- অব্রাহ্মণে কোনো পার্থক্য নেই, পার্থক্য আছে শিক্ষিত-অশিক্ষিতে। তা ছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও তিলক ও বেসান্ত উভয়েরই ভূমিকা ছিল। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি' সম্পাদনে তাঁরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন।

সরকারি দমননীতি:


হোমরুল আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ সরকারকে বিচলিত করে তোলে। সরকার দমননীতি দ্বারা হোমরুল আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চেষ্টা করে। তিলককে রাজদ্রোহিতার অজুহাতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অর্থদণ্ড করা হয়। বেসান্তকে ‘ওটকামণ্ড' শহরে অন্তরীণ রাখা হয়। তিলক ও বেসান্তের গ্রেপ্তারে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গান্ধিজী সরকারের কাজকে ‘মারাত্মক ভ্রম' বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিরোধ আন্দোলনের হুমকি দেয়।

ফলে হোমরুল আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা ও লন্ডনে হোমরুল লিগের শাখা স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নিযুক্ত একটি কমিটিও ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সমর্থন জানায়। বেসান্ত প্রমুখের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে স্যার সুব্রহ্মণম আয়ার 'নাইট' উপাধি বর্জন করেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ সরকারি নীতির প্রতিবাদে হোমরুল লিগের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। সরকার বুঝতে পারে যে, কঠোর নীতি দ্বারা এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না। ফলে সরকার পিছু হটে আসে। নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতবাসীর জন্য প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করে।

আন্দোলনের গুরুত্ব:


হোমরুল আন্দোলন সারা দেশে গণ-জাগরণ ঘটায়। কেবল বক্তৃতা বা প্রস্তাব গ্রহণের রাজনীতির পরিবর্তে গণ-সংযোগের সূচনা হয়। স্বাধীনতার পূর্ব পদক্ষেপ হিসেবে স্বশাসনের দাবি ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় সূচনা করে।

হোমরুল আন্দোলনের সাফল্য আবার জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে চরমপন্থীদের প্রতিষ্ঠিত করে। জুডিথ ব্রাউন লিখেছেন : “কতজন মানুষ হোমরুল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তা বড়ো কথা নয়, এই আন্দোলন যে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিল, সেটিই বড়ো কথা।” বস্তুত কংগ্রেসের আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল শহরে ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে।

হোমরুল আন্দোলনের শিকড় প্রসারিত ছিল গ্রামের মধ্যে। কৃষক, ব্যবসায়ী, ছাত্র, সাধারণ কর্মচারী প্রভৃতি রাজনীতিবিমুখ বহু মানুষকে হোমরুল আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামাতে সক্ষম হয়। হোমরুল আন্দোলনকে গণ-আন্দোলন বলা যাবে না, তবে এই আন্দোলন ভারতে গণ-আন্দোলনের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হোমরুল লিগ ভারতবাসীর মনে নতুন করে স্বাধিকার অর্জনের আশা সঞ্চার করে। সেই আশায় পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয় গান্ধীজির হাত ধরে। অধ্যাপক মজুমদারের ভাষায় : "The Homerule movement marked the beginning of a new phase in Indian struggle for freedom."


আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area