Ads Area


স্বরাজ্য দলের উৎপত্তি ও কার্যক্রমের ইতিহাস আলোচনা করো

স্বরাজ্য দল

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে স্বরাজ্য দলের উৎপত্তি ও কার্যক্রমের ইতিহাস, স্বরাজ দলের উদ্দেশ্য কি ছিল, ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

স্বরাজ্য দলের উৎপত্তি ও কার্যক্রমের ইতিহাস আলোচনা করো

স্বরাজ্য দলের উৎপত্তি ও কার্যক্রমের ইতিহাস আলোচনা করো। এর ব্যর্থতার কারণগুলি কী ছিল? (Describe the rise and activities of the Swarajya Party. Why did it fail?)

উত্তর-

অসহযোগ আন্দোলন অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেলে ভারতের রাজনীতিতে এক অনিশ্চিত অবস্থার উদ্ভব হয়। গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করে ছয় বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যান্য নেতারাও কারারুদ্ধ হন। ফলে নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দেয়। অথচ গান্ধীজি জনগণের মধ্যে যে নবচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, তার ফলে তারা আন্দোলনমুখী হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহরু দেশবাসীর সামনে এক নতুন কর্মসূচি তুলে ধরেন। তাঁদের নেতৃত্বে কংগ্রেসের একাংশ সংসদীয় কাজে অংশ নিতে প্রয়াসী হয়।

তাঁরা দাবি করেন যে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ‘মন্টফোর্ড’ আইন অনুযায়ী নির্বাচনে যোগ দিয়ে কাউন্সিলে নির্বাচিত হতে হবে ও কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে সরকারের কাজের সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে গান্ধীজি কর্তৃক গৃহীত আইনসভা বর্জনের নীতি পরিত্যক্ত হবে বলে রাজা গোপালাচারী, কস্তুরী রঙ্গ আইয়ার, ড. আনসারী প্রমুখ মনে করেন।

ফলে তাঁরা এই নীতির বিরোধিতা করেন। তাঁরা তাঁদের মতের সপক্ষে বলেন যে, কংগ্রেস আইনসভায় প্রবেশ করে সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে কংগ্রেসের সাথে জনগণের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যাবে ও কংগ্রেসের গঠনমূলক কাজ ব্যাহত হবে। গয়া কংগ্রেসে (১৯২২ খ্রিঃ) কাউন্সিল বয়কটের প্রস্তাবই পাশ হল। ফলে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করলেন। এরপর তিনি মতিলাল নেহরু, বিঠলভাই প্যাটেল, মদনমোহন মালব্য প্রমুখের সাথে মিলিতভাবে গঠন করলেন কংগ্রেস খিলাফৎ স্বরাজ্য দল বা সংক্ষেপে স্বরাজ্য দল।

স্বরাজ্য দলের সমর্থক গোষ্ঠী 'পরিবর্তনপন্থী' বা 'Pro-changer নামেও বিরোধী দলকে 'পরিবর্তনবিরোধী' বা 'No-changer' বলে অভিহিত করা হয়। স্বরাজ্য দলের সভাপতি হন চিত্তরঞ্জন দাশ ও প্রধান সম্পাদক হন মতিলাল নেহরু।

কর্মসূচি:

স্বরাজ্য দল ও কংগ্রেসের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য খুব একটা ছিল না। কংগ্রেসের তথা গান্ধীজির অহিংস ও অসহযোগ নীতির ওপর এঁদের সম্পূর্ণ আস্থা ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসবাদে চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসী ছিলেন না। যুগান্তর গোষ্ঠী যদিও ঐ দলে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু তাদের বলা হয়েছিল যে, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হলে তাদের দলের যোগাযোগ ছিন্ন করতে হবে। বস্তুত কংগ্রেস বা স্বরাজ্য দল কেউই চায়নি যে, ইংরেজ তৎক্ষণাৎ ভারতে ত্যাগ করুক। স্বরাজ্য দল ঐ পরিকাঠামোর মধ্যে থেকেই ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস' লাভ করতে চেয়েছিল। গণ-আন্দোলনের পথে নয়, সাংবিধানিক পথে লড়াই চালানোই ছিল দলের লক্ষ্য। তা ছাড়া মতিলাল ও চিত্তরঞ্জন উভয়েই গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

অন্যদিকে গান্ধীজিও স্বরাজ্য দলকে কংগ্রেসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকৃতি দেন। এইভাবে উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়। স্বরাজ্য দল কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই তাদের কর্মসূচি রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেয়।

তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল- (১) আইনসভায় প্রবেশ করে সরকারি কাজের বিরোধিতা করা, (২) সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করা, (৩) জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক বিল ও প্রস্তাব উত্থাপন করে সরকারকে বিব্রত করা, (৪) সরকারি অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা। ক্রমশ কংগ্রেস সদস্যদের ওপর স্বরাজ্য দলের প্রভাব বিস্তৃত হয়। জাতীয় কংগ্রেস কোনো বিকল্প কর্মসূচি দিতে না-পারায় জনগণও স্বরাজ্য দলের সমর্থনে এগিয়ে আসে। অবশেষে মৌলানা আজাদের উদ্যোগে জাতীয় কংগ্রেস স্বরাজ্য দলের সমর্থকদের ঘোষিত কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়।

কার্যাবলী:

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় : ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে স্বরাজ্য দল বিপুলভাবে জয়লাভ করে। বাংলাদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ ও আসামে এই দল কমবেশি আসনে জয়ী হয়। সবচেয়ে চমকপ্রদ সাফল্য দেখা যায় বাংলা ও মধ্যপ্রদেশে। বাংলায় ৮৫টি আসনের মধ্যে ৪৫টি আসন দখলে আসে। মুসলমানদের সঙ্গে চিত্তরঞ্জন যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে তারা স্বরাজ্য দলের সমর্থকে পরিণত হয়েছিল।

বাংলার ৪৫টি আসনের মধ্যে ২১টিই ছিল মুসলিম আসন। মধ্যপ্রদেশে স্বরাজ্য দল ৫৪টির মধ্যে ৪১টি আসন লাভ করে। তবে বিহার ও উড়িষ্যায় স্বরাজ্য দল একটিও আসন পায়নি। কেন্দ্রীয় আইনসভাতেও স্বরাজ্য দল জাতীয়তাবাদী পার্টি গঠন করে মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে।

একই নীতি প্রাদেশিক আইনসভাগুলির ক্ষেত্রেও গৃহীত হয়। স্বরাজ্য দল সরকারের কাছে যে দাবিগুলি পেশ করে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান, দমনমূলক আইন রদ করা ও শিল্পের ক্ষেত্রে ভারতীয় উদ্যোগের প্রসার ঘটানো। এ ছাড়া একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিও জানানো হয়।

এইসব দাবি সম্বলিত প্রস্তাব উত্থাপিত হলে সরকার বারংবার ভোটে পরাজিত হতে থাকেন। কিন্তু সরকার দাবি মেনে নেবার ব্যাপারে অনমনীয়ই থাকে। বিশেষত মতিলালের সঙ্গে জিন্নাহর বনিবনার অভাব সরকারের সামনে দাবি মেনে না- নেবার মতো সুযোগের সৃষ্টি করেছিল। তবে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন ও প্রস্তাব গ্রহণ করে। সরকারকে বারবার পরাস্ত করার মাধ্যমে এই দলের সদস্যরা সরকারি কাজে যথাসম্ভব বাধা সৃষ্টি করতে থাকেন। তা ছাড়া তাদের প্রতিবাদের ফলে জাতীয় দাবির প্রতিও জনগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।

পৌরসভা:

বিভিন্ন পৌরসভা নির্বাচনেও স্বরাজ্য দল বিজয়ী হয়। কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে (মার্চ, ১৯২৪ খ্রিঃ) স্বরাজ্য দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। চিত্তরঞ্জন মেয়র নির্বাচিত হন। প্রধান কার্যনির্বাহের পদ অলংকৃত করেন সুভাষচন্দ্র বসু। বোম্বাই পৌরসভায় বিঠলভাই প্যাটেল, আমেদাবাদে বল্লভভাই প্যাটেল, এলাহাবাদে জওহরলাল নেহরু ও পাটনায় রাজেন্দ্রপ্রসাদ পুরপিতার পদ অলংকৃত করেন। এই সাফল্য স্বরাজ্য দলকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়ঃপ্রণালী উন্নতিবিধান, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ইত্যাদি কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ এনে দেয়। স্বরাজ্য দল অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিরোধী কংগ্রেস নেতারাও এইসব কাজে স্বরাজ্য দলের কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়ান।

স্বরাজ্য দলের ভাঙন:

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের অকালপ্রয়াণ দলে দারুণ সঙ্কটের সৃষ্টি করে। দলের মধ্যে মতভেদ প্রকট হয়। মতিলাল নেহরুর সাথে ন্যাশনালিস্ট পার্টির মহম্মদ আলি জিন্নাহর মতপার্থক্য ঘটে। দলকে দুর্বল করার জন্য বড়োলাট রীডিং এই মতবিরোধকে মদত যোগাতে থাকেন। এদিকে বাংলাতে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের মধ্যে নেতৃত্বের বিরোধ দেখা দেয়। উত্তরপ্রদেশে একই বিরোধ দানা বাঁধে মতিলাল ও মদনমোহন মালব্যর মধ্যে। কেলকার, জয়াকার, মুণ্ডে প্রমুখ নতুন দল গড়েন। এইসব দলাদলি স্বরাজ্য দলের ভাবমূর্তিকে মলিন করে। ১৯২৬-এর নির্বাচনে দলের ফলাফল যথেষ্ট খারাপ হয়। পরিশেষে দলের অধিকাংশ সদস্যই কংগ্রেসে ফিরে আসেন।

ব্যর্থতার কারণ:

স্বরাজ্য দলের পরিকল্পনা ছিল বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে সরকারি কাজের বিরোধিতা করা ও পরিশেষে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করা। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। দলের এই ব্যর্থতার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, আইনসভায় বাজেট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশের ক্ষেত্রে যখনই স্বরাজ্য দলের সদস্যরা ভোটে জিতে বাধাদানের চেষ্টা করেছে, তখনই গভর্নর তার বিশেষ ক্ষমতার দ্বারা আইনটি পাশ করিয়ে নিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার পরিবর্তে অনেকেই মন্ত্রিত্বের মোহে আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েন । তৃতীয়ত, দলের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ ও দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল করে তোলে। দলের ভাবমূর্তি মলিন হয়। চতুর্থত, স্বরাজ্য দলের কাউন্সিলে যোগদানের কর্মসূচি অপেক্ষা গান্ধীজির গ্রামোন্নয়ন ও হরিজন আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল অনেক জনপ্রিয়।তা ছাড়া চিত্তরঞ্জন কৃষক-শ্রমিকদের আন্দোলনে শামিল করেননি।

ফলে স্বরাজ্য দল জনমানসে উল্লেখযোগ্য সাড়া জাগাতে পারেনি। পঞ্চমত, এইসবের ফলশ্রুতিতেই ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে দলের ফলাফল হয় খুবই হতাশাজনক। অবশ্য এজন্য চিত্তরঞ্জনের অকালমৃত্যুও অনেকটাই দায়ী ছিল। তাঁর অবর্তমানে দলের অবস্থা হয় কাণ্ডারীবিহীন নৌকার মতো। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মতো সর্বস্ব পণ করে আর কেউই দল চালাবার কাজে অগ্রসর হননি।

অবদান:

স্বল্পস্থায়ী হলেও স্বরাজ্য দল ভারতীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট কৃতিত্বের অধিকারী। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর ভারতীয় রাজনীতিতে যে গতিহীনতার সৃষ্টি হয়েছিল স্বরাজ্য দলের কার্যকলাপ ও কর্মসূচি তার অবসান ঘটায়। ভারতীয় রাজনীতিতে আবার গতিময়তার সঞ্চার হয়।

এই দলের সদস্যরা আইনসভায় জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটান ও সেই সাথে ব্রিটিশ প্রশাসনের স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত করেন। আইনসভায় তাদের কার্যকলাপ প্রমাণ করেন যে, ভারতবাসীগণ দায়িত্বশীল সরকার গঠনে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।

গান্ধীজি স্বরাজ্য দলের নীতি সমর্থন করেননি। কিন্তু তিনি তাদের কাজে বাধাও দেননি। কারণ স্বরাজ্য দলের নেতাদের আদর্শ ও নিষ্ঠা সম্পর্কে তাঁর কোনো সংশয় ছিল না। তাই গান্ধীজি তাঁদের “খুবই সম্মানিত ও মূল্যবান” (most valued and respected) বলে উল্লেখ করেছেন। স্বরাজ্য দলের অবদান প্রসঙ্গে গান্ধী বলেছেন, “তাঁরা একাগ্রতা, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও সংহতিবোধের প্রমাণ দিয়েছেন এবং নিজেদের আদর্শকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে ভীত হননি। একথা স্বীকার করতে হবে যে, তাঁরা ভারতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন।”


আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area