Ads Area


খিলাফত আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

খিলাফত আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে খিলাফত আন্দোলন সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

খিলাফত আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

খিলাফৎ আন্দোলনের সূচনা, প্রসার ও পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করো। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ওপর এর প্রভাব কী ছিল? (Analyse the introduction growth and results of the Khilafat Movement.)


উত্তর-

ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যে সকল গণ-আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, তাদের অন্যতম ছিল খিলাফৎ আন্দোলন। পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদী গণহত্যা ও গণ-অত্যাচারের পটভূমিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তন খিলাফৎ আন্দোলনের পশ্চাৎপট রচনা করেছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও খিলাফৎ আন্দোলন বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক, মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। এই ঘটনায় ভারতীয় মুসলমান সমাজ কিছুটা বিব্রত বোধ করে। কারণ তুরস্কের খলিফা ছিলেন সমগ্র মুসলমান সমাজের প্রধান ধর্মগুরু। অথচ ব্রিটিশ সরকারের সাথে ভারতীয় মুসলমানদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এমতাবস্থায় মুসলমানদের সহানুভূতি ও সমর্থনলাভের আশায় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধশেষে তুরস্কের প্রতি ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেয়। কিন্তু যুদ্ধশেষে মিত্রশক্তি তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ব্যবচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তুর্কি সুলতান তথা খলিফা তার অধিকার ও কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত হন। ধর্মগুরু খলিফার কর্তৃত্ব ও অধিকারের অবনমন ও মর্যাদাহানি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে নিদারুণ ব্রিটিশবিরোধী বিক্ষোভ সঞ্চার করে।

ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিরা সারা ১৯১৯ সাল ধরে ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই প্রতিবাদে নীরব থাকে। এই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভারতের নানা স্থানে খিলাফৎ কমিটি স্থাপিত হয়। ১৯১৯-এর নভেম্বর মাসে দিল্লিতে সর্বভারতীয় খিলাফৎ সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে বহু কংগ্রেস নেতা অংশ নেন।

এখানে ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট ও ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এইভাবে খিলাফৎ আন্দোলনের সূচনা ঘটে। মহাত্মা গান্ধী খিলাফৎ আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলে এই আন্দোলন একটা জাতীয় চরিত্র পায়। একান্ত ধর্মীয় কারণে এই আন্দোলনের সূচনা হলেও দুরদর্শী গান্ধীজি ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার লে আন্দোলনে যোগ দেন।

কর্মসূচি:


১৯২০-র প্রথমদিকে খিলাফত কমিটির পক্ষে গান্ধীজি একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন। এই ইস্তাহারে তিনি অহিংস অসহযোগের তত্ত্ব বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং ভারতীয় হিন্দু সমাজকে খিলাফতের সমর্থনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দেন যে, ভারতের অন্যান্য শাসন-সংক্রান্ত দাবিদাওয়ার তুলনায় এই মুহূর্তে খিলাফৎ প্রশ্নটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

খিলাফৎ আন্দোলনের তিনটি প্রধান লক্ষ্য ছিল- (১) খলিফার পার্থিব সাম্রাজ্য অটুট রাখা, (২) আরব, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মেসোপটেমিয়ার ওপর খলিফার কর্তৃত্ব বজায় রাখা এবং (৩) পবিত্র মক্কা ও মদিনার ওপর বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা। প্রথমদিকে মূলত বোম্বাই নিবাসী ধনী ব্যবসায়ীরা খিলাফৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এঁরা সভাসমিতি, স্মারকলিপি প্রদান ও জনমত গঠন ইত্যাদি মধ্যপন্থী আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে।

সৌকত আলি, মহম্মদ আলি, মৌলানা আজাদ প্রমুখ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে খিলাফৎ আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। খিলাফৎ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এই ব্যর্থতার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল। খলিফা পদের বিলোপ। ১৯২২ সালে কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে নতুন সরকার গঠিত হলে সুলতান তথা খলিফা তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেন। কামাল পাশা খিলাফতের অবসান ঘটান এবং তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা করেন। স্বভাবতই খিলাফতের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে খিলাফৎ আন্দোলনও রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে।

প্রকৃতি:


খিলাফৎ আন্দোলনের প্রকৃতি ও ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা নানা। মত পোষণ করেছেন । বস্তুত ব্রিটিশ আনুগত্যের মোহ ত্যাগ করে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম হিসেবে খিলাফৎ আন্দোলনের নাম স্মরণ করা যায়। পরন্তু এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। গান্ধীজির নেতৃত্বে হিন্দু মুসলমান ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রাজনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করে।

সর্বোপরি খিলাফৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক চেতনার সূচনা ঘটে। কিন্তু এই আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা ও সম্পূর্ণতাকে অস্বীকার করা যায় না। প্রথমত, এই আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ধর্ম। স্বভাবতই মুসলমানদের কাছে বিষয় স্পর্শকাতর হলেও অমুসলমানদের কাছে এর আন্তরিক আবেদন না-থাকা অস্বাভাবিক নয় অর্থাৎ খিলাফৎ আন্দোলনের আবেদন ছিল খণ্ডিত।

দ্বিতীয়ত, যে-কোনো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে আর্থসামাজিক শোষণ ও অসন্তোষ শ্রেণি ও সম্প্রদায়নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। কিন্তু খিলাফতিরা ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বাস্তব দিকটি সম্পর্কে নীরব ছিলেন। স্বভাবতই গরিব অমুসলমান নয়- গরিব মুসলমানেরাও খিলাফৎ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক কারণেও সমস্ত শ্রেণির মুসলমান এই আন্দোলনকে সমানভাবে সমর্থন করেনি। ধর্মীয় আনুগত্যের বিনিময়ে উচ্চবিত্ত মুসলমানরা তাদের আর্থিক বা ব্যবসায়িক সাফল্য ক্ষুণ্ণ করতে রাজি ছিলেন না। তাই দেখা যায়, বোম্বাইয়ে বহু বিত্তশালী মুসলমান বয়কট আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন।

চতুর্থত, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ধর্মনিরপেক্ষ উদ্দেশ্যকে ম্লান করেছিল। ধর্মভিত্তিক এই আন্দোলনে গান্ধীজির লক্ষ্য ছিল অবশ্যই মহৎ। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না।। কিন্তু বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার তুলনায় তিনি এক্ষেত্রে ভাবাবেগ দ্বারা বেশি চালিত হয়েছিলেন। জুডিথ ব্রাউন মনে করেন, গান্ধী তাৎক্ষণিক হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির লোভে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

তিনি লিখেছেন : "The mechanism by which Gandhi had gathered wideserd Muslim support was also a political Boomerang ড. অমলেশ ত্রিপাঠী তার 'স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস' প্রবন্ধে লিখেছেন : “গান্ধী ভাবতে পারেননি যে, এ ধরনের মৈত্রী তাৎক্ষণিক সাফল্যলাভ করলেও উলেমাদের প্রাধান্য ভবিষ্যতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঘাত করবে।” ড. খালিদ বিন সৈয়দ তাঁর 'Pakistan the formative phase ... গ্রন্থে লিখেছেন যে, খিলাফৎ আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। অ্যানি বেসান্ত খিলাফৎ আন্দোলনের গোঁড়া ধর্মীয় চরিত্র, বিদ্রোহী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য এবং Pan-Islamic দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারতে মুসলমান রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখেছিলেন।

হিন্দু-মুসলমান ঐক্য পুনঃ স্থাপনে গান্ধীজির প্রয়াস প্রায় ব্যর্থ হয়েছিল। লক্ষণীয়, কামাল পাশা খলিফার পদ বিলোপ করলে মুসলমান সমাজ বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধিতায় ভাটার টান এসেছিল। অথচ যদি ধর্মীয় ভিত্তির ওপর নির্ভর না করে জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে এই আন্দোলন গড়ে উঠত, তা হলে। হিন্দু, মুসলিম ঐক্যের ভিত অবশ্যই জোরদার হত।

আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area