Ads Area


ভারতের রাজনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে ভারতের রাজনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

ভারতের রাজনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

ভারতের রাজনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব উল্লেখ করো। (Narrate the impact of the First World War on Indian Politics.)

উত্তর।

জাতীয় রাজনীতির ভাঙন:

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে ভারতের জাতীয় আন্দোলন অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিল। নরমপন্থী রাজনীতির ধারার উপর তখন মানুষের আস্থা অনেকটাই শিথিল হয়েছিল। অন্যদিকে চরমপন্থীরাও নানা কারণে তখন নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল। ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নেতৃত্বের সংকট তখন যেন প্রবল হয়ে সামনে এসেছিল।

তিলক কারাগারে বন্দি ছিলেন। বিপিনচন পাল ও লালা লাজপত রায় যথাক্রমে লন্ডনে ও আমেরিকায় গিয়ে প্রবাসী জীবন বেছে নিয়েছিলেন। 'অনুশীলন সমিতি', 'যুগান্তর দল', 'সুহৃদ সমিতি', 'ব্রতী সমিতি' ইত্যাদি সংগঠন সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ রাজনীতির সাথে সম্পর্ক ছেদ করে পণ্ডিচেরীতে গিয়ে আধ্যাত্মিকচর্চার জীবন বেছে নিয়েছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখের সেই জনমোহিনী ভাবমূর্তি তখন অতীতের স্মৃতিমাত্র। এইরূপ অনুজ্জ্বল রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে উঠলে, স্বভাবতই ভারত ও ভারতবাসী অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হন।

কংগ্রেসের সমর্থন:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম শরিক দল ব্রিটেন ভারতবর্ষকেও যুদ্ধের পক্ষ হতে বাধ্য করেছিল। ব্রিটিশের ব্যাখ্যায় এই যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আদর্শের লড়াই। তাই এই যুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষ সমর্থনের নৈতিক দাবি ছিল যথেষ্ট জোরালো। স্বভাবতই জাতীয় কংগ্রেস এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন এগিয়ে আসে। জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে (১৯১৪ খ্রিঃ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ভারতবাসী আন্তরিকভাবে এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করবে -এই প্রত্যয় জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করে। এমনকি চরমপন্থী নেতা বালগঙ্গাধর তিলকও ঘোষণা করেন যে, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই দুর্দিনে ধনীদরিদ্রনির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর কর্তব্য হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা।” গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং সরকারের প্রতি সহযোগিতা করার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান।

যুদ্ধ শুরু হলে সকল শ্রেণির ভারতবাসী ব্রিটিশ সরকারকে নৈতিক সমর্থন জানায়। ভারতের রাজন্যবর্গ, জমিদার, বণিক থেকে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ সবাই ব্রিটিশ সরকারের সাফল্য কামনা করে যুদ্ধের সমর্থনে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। ভারতবাসীর সমর্থনের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিন্তে যুদ্ধে অংশ নিতে সক্ষম হয়। এমনকি প্রাচ্য ভূখণ্ডে মিত্রপক্ষের যুদ্ধের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ভারতভূমির ব্যবহারও সহজ হয়ে যায়। যুদ্ধকালে প্রায় ১২ লক্ষ ভারতবাসী সেনাদলে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। সমকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাসকুইথ (Asquith) এই যুদ্ধে ভারতবাসীর সাহায্য ও সমর্থনের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।

আশা ভঙ্গ:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবাসীর অংশগ্রহণ প্রত্যাশাবিহীন ছিল না। বলা যায়, গভীর এক আশাবাদকে সামনে রেখেই ভারতীয় নেতা ও জনগণ এই যুদ্ধে ব্রিটেন তথা মিত্রপক্ষের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল। এই যুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদের। গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল ব্রিটেন ও মিত্রপক্ষ। তাই ভারতবাসীর আশা ছিল। যে, যুদ্ধাবসানে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবি মেনে নিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু অকৃতজ্ঞ ব্রিটিশ সরকার ভারত সম্পর্কে তাদের চিরাচরিত ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে থাকে। ভারতীয়দের হাতে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তুলে দিতে সরকার আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তার ফলে আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় ভারতবাসী যুগপৎ কাতর হয় এবং পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপায়ণের পটভূমি তৈরির সহায়ক পরিস্থিতি গড়ে তোলে।

আন্দোলনের সূচনা:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটেন ও তার সহযোগী দেশগুলি তাদের উপনিবেশগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও ঔদাসীন্য দেখায়। যুদ্ধকালীন প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাহ্য করে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলে মুসলিম সমাজ প্রতিবাদ করে। ভারতেও সেই প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

জাতীয় কংগ্রেস খিলাফতের দাবিকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় মিশরের জাতীয়তাবাদী দল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম করেছিল। ১৯২০-তে মিশরের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এই সময় কামালপাশার নেতৃত্বে তুরস্কে অস্থায়ী সরকারের প্রতিষ্ঠা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

দূর প্রাচ্যে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চিনে জাপানি পণ্য বয়কট শুরু হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডে শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ- বিরোধী আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলনকেই ভারতবাসী অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় এবং আইরিশ বিপ্লবী ও চিনা জনগণের আন্দোলন থেকে নতুন প্রেরণা অর্জন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হল রাশিয়াতে বলশেভিক বিপ্লবীদের সাফল্য। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুশ শ্রমজীবী মানুষের এই সাফল্যে ভারতবাসী গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

১৯১৮-তে জাতীয় কংগ্রেস ভারতের জন্য জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি উত্থাপন করে। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকারের উচিত “ভারতের জনপ্রতিনিধিদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ভারতে আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করা।” রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে নবপ্রাণের সঞ্চার করেছিল।

ব্রিটিশ সরকারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে অতঃপর জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ যৌথ কর্মসূচি গ্রহণে তৎপর হয়েছিল। একদিকে জাতীয় কংগ্রেসে চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মিলন এবং অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের যৌথ কর্মসূচি রূপায়ণের ইচ্ছা- প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতীয় রাজনীতিকে নতুন গতিবেগ দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area