Ads Area


ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর উত্থান

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর উত্থান

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর উত্থান সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর উত্থান

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজির উত্থানের পশ্চাৎপট আলোচনা করো। (Analyse the background of the rise of Gandhiji to Indian Politics.)


অথবা

জাতীয় রাজনীতিতে যোগদানের আগে গান্ধীজি দেশে-বিদেশে কীভাবে গণ- আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন ? (How Gandhiji organised movements in India and abroad before his participation in Indian Politics ?)


উত্তর-

ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজির যোগদান একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত হয়। গান্ধীজির সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাপন পদ্ধতি, ন্যায়বাদিতা এবং প্রখর অথচ দরদি ব্যক্তিত্ব ভারতের সমস্ত স্তরের মানুষকে একই পতাকাতলে সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করে। গান্ধীজির মধ্যে ভারতবাসী প্রথম একজন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সন্ধান পায়। জাতীয় স্বার্থে ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনে সংগঠিত করে তিনি বিদেশি শাসকের সামনে প্রথম জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দক্ষিণ আমেরিকায়। 'নাটালে' আইন ব্যবসা শুরু করেন। দক্ষিণ আফ্রিকাতেই গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে বহু ভারতীয় বাস করত। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার এই সকল প্রবাসী ভারতীয়র ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাত।

এই সকল ভারতীয়র কোনো ভোটাধিকার ছিল না। কোনো ভালো জায়গায় তারা বাস করতে পারত না। সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের বাস করতে হত। এই সকল অঞ্চল ছিল ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর। রাজপথের ফুটপাথ দিয়ে তারা হাঁটতেও পারত না। অথচ ভারতীয়দের নানা অপমানজনক শর্ত মেনে চলতে হত।

যেমন- (১) চুক্তিবদ্ধ যেসব শ্রমিক দক্ষিণ আফ্রিকায় যেত, তাদের কেউ কেউ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার পরেও প্রাণধারণের জন্য সেখানে থেকে যেত। এজন্য তাদের মাথাপিছু ৩ পাউন্ড ট্যাক্স দিতে হত। (২) ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের এক আইন দ্বারা ট্রান্সভালে বসবাসকারী ভারতীয়দের দাগী আসামীর মতো আঙুলের ছাপ দিয়ে নাম নথিভূত করতে হত। (৩) কেবল খ্রিস্টান বিবাহ-পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো বিবাহ রীতি বৈধ বলে গণ্য হত না।

এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের শোষণ ও অত্যাচার গান্ধীজিকে বিচলিত করে। জাতিবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ- বিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে তিনি গণ-আন্দোলন সংগঠিত করেন। সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করে তিনি গড়ে তোলেন 'নাটাল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস'।

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার নানাভাবে গান্ধীজিকে বিব্রত করার চেষ্টা চালায়। তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টাও চালানো হয়। এতদ্‌সত্ত্বেও দীর্ঘ দুই দশক তিনি অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান রিলিফ অ্যাক্ট' গৃহীত হয়।

সত্যাগ্রহ আদর্শ:


দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলনে গান্ধীজি এক নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এই পদ্ধতি 'সত্যাগ্রহ' নামে পরিচিত।

তিনি রাজনৈতিক অধিকার অবলম্বন আদায়ের অস্ত্র হিসেবে 'সত্যাগ্রহ' নীতি প্রয়োগ করেন। সত্যাগ্রহের দুটি মূল আদর্শ হল – (১) সত্যের প্রতি একান্ত অনুরাগ এবং (২) অহিংস উপায়ে সত্যের পথে এগিয়ে যাওয়া। একজন আদর্শ সত্যাগ্রহী কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের সাথে আপস করবে না। আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় সে কিছুতেই হিংসার আশ্রয় নেবে না। এজন্য প্রয়োজন অনুশীলন ও অধ্যবসায়। অন্যায়ের বিরদ্ধে লড়াই করার সময় একজন সত্যাগ্রহীকে সমস্ত দুঃখকষ্ট, নির্যাতন হাসিমুখে সহ্য করতে হবে।

গান্ধীর মতে, দুর্বল বা কাপুরুষরাই হিংসার আশ্রয় নেয়। কেবলমাত্র চরিত্রবান ও সাহসী ব্যক্তির পক্ষে সত্যাগ্রহের পথ অনুসরণ করা সম্ভব। এই আন্দোলনের পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন যে, সত্যাগ্রহ আন্দোলন অন্যায়কারীকে সংকটের মাঝে নিক্ষিপ্ত করবে। কারণ শান্ত ও অহিংস সত্যাগ্রহীদের ওপর নিপীড়ন চালালে সে সাধারণ মানুষের নৈতিক সমর্থন হারাবে। অন্যদিকে সে নিষ্ক্রিয় থাকলে সত্যাগ্রহীদের আন্দোলন ব্যাপক ও জোরদার হয়ে অন্যায়কারীর পতন ঘটাবে। গান্ধীজি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সত্যাগ্রহ নীতি প্রয়োগ করে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

ভারতে প্রত্যাবর্তন:


দক্ষিণ আফ্রিকায় সফল আন্দোলনের পর গান্ধীজি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন (১৯১৫ খ্রিঃ)। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকেও "যুদ্ধরত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। গান্ধীজি তখন ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন। যুদ্ধের মাঝপথে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দ্বারা সরকারকে বিব্রত করার তিনি বিরোধী ছিলেন। 

পরন্তু তিনি সরকারের সাথে সহযোগিতা করার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। অবশ্য সেই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল না। কংগ্রেসের নরমপন্থী বা চরমপন্থী কোনো গোষ্ঠীর নীতি ও পদ্ধতি তাঁর মনঃপূত ছিল না। দেশবাসীকে নিজের আদর্শে উদবুদ্ধ করার জন্য তিনি আমেদাবাদে সবরমত নদীর তীরে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন (১৯১৬ খ্রিঃ)। এখানে তিনি নিজ অনুগামীদের সত্যাগ্রহ নীতি সম্পর্কে শিক্ষাদান করতেন।

চম্পারণ সত্যাগ্রহ:


ভারতের রাজনীতিতে যোগদানের আগে গান্ধীজি কয়েকটি আঞ্চলিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯১৭ ও ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বিহারের চম্পারণে একটি গণবিক্ষোভ সংগঠিত হয়। ইউরোপীয় নীলচাষীদের দাপটে চম্পারণের নীলচাষীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। নীলকর সাহেবরা স্থানীয় চাষীদের জমিতে নীলচাষ করতে তাদের বাধ্য করত। নীলচাষ না-করলে চাষীদের ওপর তারা অকথ্য নির্যাতন চালাত। এই নীলচাষ করে চাষীদের ক্ষতি ছাড়া লাভ হত না।

কারণ নীলকর সাহেবদের নির্ধারিত নামমাত্র মূল্যে চাষীদের নীল বিক্রয় করতে বাধ্য করা হত। চম্পারণ জেলার কিছু কৃষক এই অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভের জন্য গান্ধীজির সাহায্য চান। গান্ধীজি চম্পারণে তাঁর 'সত্যাগ্রহ নীতি' প্রয়োগ করার সুযোগ পান। গান্ধীজি কৃষকদের দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, মজাহরুল হক, জে. বি. কৃপালনী ও মহাদেব দেশাইকে সঙ্গে নিয়ে চম্পারণে উপস্থিত হন।

স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষ গান্ধীজিকে চম্পারণ ত্যাগ করে চলে যেতে আদেশ দেন। কিন্তু গান্ধীজি এই আদেশ অমান্য করে নীলচাষীদের দুর্দশা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকেন। সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও তিনি সিদ্ধান্তে স্থির থাকেন।

গান্ধীজির দৃঢ়তা দেখে কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। শেষ পর্যন্ত সরকার নীলচাষ সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি' (Enquiry Committee) গঠন করে। গান্ধীজিকেও এই কমিটির সদস্য করা হয়। এর ফলে নীলচাষীদের দুঃখকষ্টের অবসান ঘটে। চম্পারণের আন্দোলন দুটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের রাজনীতিতে 'সত্যাগ্রহ' আদর্শের সফল প্রয়োগ ঘটে দ্বিতীয়ত, চম্পারণে গান্ধীজি প্রথম কৃষক সমাজের সংস্পর্শে আসেন। ফলে কৃষকশ্রেণির সাথে তাঁর একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়।

আমেদাবাদ সুতোকল ধর্মঘট:


গান্ধীজির রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বিতীয় কেন্দ্র ছিল আমেদাবাদ। আমেদাবাদের সুতোকলের শ্রমিকরা বেতনবৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। গান্ধীজির নির্দেশে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। শ্রমিকদের দাবির সমর্থনে গান্ধীজি অনশন শুরু করেন। তাঁর অনশন চতুর্থ দিনে পড়লে মিল মালিকরা শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। শ্রমিকদের বেতন শতকরা ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। আমেদাবাদের সুতোকল শ্রমিকদের এই আন্দোলনও দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের শ্রমিকশ্রেণির সুখ-দুঃখের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে অনশনের গুরুত্ব বোঝা যায়। অতঃপর একাধিক ক্ষেত্রে তিনি এই অস্ত্র প্রয়োগ করে সাফল্য পান।

খেদা কৃষক আন্দোলন:


গান্ধীজি গুজরাটের ‘খেদা' জেলায় ‘তৃতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন সংগঠিত করেন। অজন্মার জন্য শস্যহানি হওয়ায় খেদা'র কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। গান্ধীজি এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। সরকার কৃষকদের ওপর দমনপীড়ন শুরু করলে গান্ধীজি 'সত্যাগ্রহ' শুরু করেন। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এই আন্দোলনে গান্ধীজির সহযোগী হন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা

প্রথমে তিনি খাজনা মকুবের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। সরকার দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করে আন্দোলন ভাঙতে চেষ্টা করে। অনেকের জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তথাপি কৃষকেরা অনমনীয় দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সরকার আপস-মীমাংসায় আসতে বাধ্য হয়।

জাতীয় নেতা:


চম্পারণ, আমেদাবাদ ও খেদার আন্দোলন থেকে দেশবাসী গান্ধীজির রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছিল। তিনিও গণ-চেতনার ভিত্তি ও দুর্বলতা এবং নিজ সত্যাগ্রহ পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করতে পেরেছিলেন।

সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদের সুখ-দুঃখ ও সমস্যা জানার এবং তার সমাধানের যে ঐকান্তিক প্রয়াস তিনি দেখান, তা খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশের সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে যুব-সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর প্রতিবাদের শোনা কাহিনি এবং চম্পারণ ও খেদার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর প্রতি ভারতবাসীর আস্থাকে এমন গভীরতা দিয়েছিল যে, পরবর্তী আড়াই দশক অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত তিনিই ভারতীয় রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শীর্ষে অধিষ্ঠান করতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area